প্রকাশিত : শুক্রবার, ১০জুলাই ২০২০ইং ।। ২৬শে আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : বহু ভাষাবিদ, ভাষাতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্য-সাধক, গবেষক, সম্পাদক, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা, জ্ঞান-তাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আজকের এই দিনে ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে তাঁর জন্ম গ্রহন করে। পিতা মফিজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পীর গোরাচাঁদের দরগাহর খাদেম। পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ন ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। তিনি ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯০৪) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (১৯০৬) পাস করার পর তিনি হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন (১৯০৬-৮)। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ (১৯১০) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) পাস করেন। দুবছর পর তিনি বি.এল (১৯১৪) ডিগ্রিও অর্জন করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন; তারপর সীতাকুন্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি চবিবশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে (১৯১৫-১৯) নিযুক্ত হন। এখানে তিনি পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা-সহকারী (১৯১৯-২১) হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে (১৯২১) যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এখানে শিক্ষাদান কালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ সালে প্রমাণ করেন যে, গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
১৯২৬ সালে শহীদুল্লাহ্ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিববতি ও প্রাচীন পারসিক ভাষা এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন খোতনি, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা শেখেন। ১৯২৮ সালে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। অতঃপর সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হলে ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হন এবং ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ (১৯২২-২৫) ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খন্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৫৩-৫৫) হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযু্ক্ত হন।
অধ্যাপনার বাইরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ করাচির উর্দু& উন্নয়ন সংস্থার ‘উর্দু অভিধান প্রকল্প’, (১৯৫৯-৬০), ঢাকার বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ (১৯৬০) এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্প’-এ (১৯৬১-৬৪) সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক (১৯২১-২৫), ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট (১৯৪০-৪৪), ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য (১৯৬৩-৬৪), ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (১৯৬৩-৬৪), বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন।
তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক (১৯১১) ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন (১৯১৭), ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন (১৯২৬), কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন (১৯২৮), হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন (ভাষাতত্ত্ব শাখা, ১৯৪১) এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন (১৯৪৮)। মাদ্রাজে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রাডিশনাল কালচার ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া’ অনুষ্ঠানে তিনি ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে শহীদুল্লাহ্র বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। আল এসলাম পত্রিকার সহকারী সম্পাদক (১৯১৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯১৮-২১) হিসেবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশুপত্রিকা আঙুর (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজি মাসিক পত্রিকা দি পীস (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গভূমি (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক তকবীর (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনাসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু জটিল সমস্যার সমাধান করেন। বাংলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো:
- ভাষা ও সাহিত্য
- বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত
- দীওয়ানে হাফিজ
- রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম
- নবী করিম মুহাম্মাদ
- ইসলাম প্রসঙ্গ
- বিদ্যাপতি শতক
- বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড)
- বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
- ব্যাকরণ পরিচয়
- বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান
- মহররম শরীফ
- টেইল ফ্রম দি কুরআন
- Buddhist Mystic Songs (1960)
- Hundred Sayings of the Holy Prophet
তাঁর সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই -এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত Traditional Culture in East Pakistan (১৯৬১) একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর Buddhist Mystic Songs (১৯৬০) গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত; এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন।
পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা ঃ ১.আঙ্গুর [শিশু মাসিক পত্রিকা, কলকাতা, ১৯১৩, সম্পাদক], ২. আল ইসলাম [মাসিক পত্রিকা, কলকাতা, ১৯১৫ সহ-সম্পাদক], ৩. বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা [ত্রৈমাসিক, কলকাতা, ১৯১৮, যুগ্ম-সম্পাদক],৪. The Peace [ত্রৈমাসিক ও মাসিক, ঢাকা, ১৯২২, সম্পাদক], ৫. বঙ্গভূমি [মাসিক, ঢাকা, ১৯৩৮, সম্পাদক], ৬. তকবীর [পাক্ষিক, বগুড়া, ১৯৪৬, সম্পাদক],৭. কাজের কথা [পাক্ষিক, ১৯৫১, সম্পাদক]।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ব্যক্তি হিসাবে সকলের নিকট সমাদৃত ছিলেন। তিনি যেসব ভাষা লিখতে, পড়তে ও বলতে পারতেন তার সংখ্যা হলো ২০টি। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরাজি, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, হিব্রু, আরবি, প্রাচীন ফারসি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, ওড়িয়া, মৈথিলি, অহমিয়া, নেপালি, তিববতি, প্রাচীন সিংহলি, পোশতু, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি। এছাড়া, তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, সিন্ধি, মহারাষ্ট্রি, বেলুচি, ল্যাটিন, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ড্যানিশ, ইতালীয়, মালদ্বীপি, তুর্কি প্রভৃতি আরো প্রায় দু’ডজন ভাষায় তাঁর যৎসামান্য দখল ছিল।
তাঁর মতো বহু ভাষাবিদ সুপন্ডিত ব্যক্তি পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব, বিকাশ ও তাঁর তুলনামূলক বিচারে তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তুলনামূলক ভাষাতত্তেব তাঁর মতো অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও কাল-নিরূপণে তাঁর সমকালীন পন্ডিত-গবেষকদের মতামত খন্ডন করে তিনি নিজের মতকে অকাট্য যুক্তিসহ উপস্থাপন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নেও তিনি অনেক অজানা তথ্যের উপস্থাপন করে আমাদের ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান কেবল তুলনাহীনই নয়, অনন্য বলা চলে।
ডক্টর শহীদুল্লাহর বাংলা ভাষা-প্রীতি সর্বজনবিদিত। তাঁর সারা জীবনের সাধনা, গবেষণা, লেখালেখি, সভা-সমিতি-বক্তৃতায় এর যথার্থতা প্রমাণিত। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার বাহন, অফিস-আদালতের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য তিনি সর্বদা সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি :
এক. ১৯১৫ সনে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনীর সভাপতি হিসাবে ভাষণ দিতে গিয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন ঃ ‘‘একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সার্থক হতে পারে। …চীন ও জাপানে যদি তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে আণবিক বিজ্ঞান শিক্ষা সম্ভব, তবে বাংলা ভাষাতেই বা তা হবে না কেন? তবে ইংরাজি, ফারসি, ল্যাটিন, জার্মান, রুশ ভাষা থেকে অনেক শব্দ আমাদের গ্রহণ করতে হবে- তা সবাই করেছে। ইংরাজি ভাষাতেও বহু বিদেশী শব্দ আছে।… এতে ভাষা শক্তিশালীই হবে।’’
দুই. বাংলা ১৩২৪ সনে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’র বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন ঃ ‘‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। … মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরাণ আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন্ ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কোন পিয়াসী থাকে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন্ ভাষায় কল্পনা-সুন্দরী তাহার মনমজান ভাবের ছবি অাঁকে?… সেদিন অতি নিকট, যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করিবে। বিদেশীয় ভাষার সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মতন সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারে না।’’
তিন. ১৯১৮ সনে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ভবিষ্যৎ ভারতের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে মতামত গ্রহণের জন্য সর্বভারতীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট পন্ডিতজনদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সকলেই হিন্দীর পক্ষে মতামত দিলেও সে সভায় উপস্থিত একমাত্র ডক্টর শহীদুল্লাহ দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন : ‘‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চে। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্য-গুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’’
সেদিন ডক্টর শহীদুল্লাহর এ সত্যোচ্চারণে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই অগ্নিশর্মা হলেও শহীদুল্লাহ তাঁর যুক্তিসঙ্গত মতের উপর ছিলেন দৃঢ়-অবিচল। সততা, বলিষ্ঠতা ও সত্যোচ্চারণ ছিল জ্ঞান-তাপস ডক্টর শহীদুল্লাহর অন্যতম চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য।
চার. ১৯৪৭ সনের জুলাই মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ডক্টর শহীদুল্লাহ তার কঠোর সমালোচনা করে ইংরাজি ‘দি কমরেড’ পত্রিকায় ‘The Language Problem of Pakistan’ এবং বাংলায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন (২৯ জুলাই ১৯৪৭ তারিখে ‘দৈনিক আজাদে’ প্রকাশিত)।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান; তাঁর ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে বক্তৃতা করতেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ঃ ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স’ (১৯৫৮), সংবর্ধনা ঃ পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ (১৯৫৮)। আশি বছরপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের গবেষণা পত্রিকা ‘সাহিত্য পত্রিকার’ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা সংখ্যা (১৯৬৫) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পত্রিকা ‘সাহিত্যিকা’র শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা সংখ্যা (১৯৬৬) প্রকাশ করে। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত ‘Shahidullah Felicitation Volume’ (১৯৬৬), মুহম্মদ সফিয়ুল্লাহ সম্পাদিত ‘শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ’ (১৯৬৭) এবং ডক্টর আনোয়ার এস দীল সম্পাদিত ‘Shahidullah Presentation Volume’ (১৯৬৭), ২০০২ সনে একুশের মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট পদক (মরণোত্তর) লাভ।
‘জ্ঞানতাপস’ হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় পরলোক গমন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হল চত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..