প্রকাশিত: শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯।। ১৩ আশ্বিন,১৪২৬ বঙ্গাব্দ।
বিক্রমপুর খবর ডেস্ক: ড.নূহ-উল-আলম লেনিন
শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার নেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। গত ৩৮ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি এই দায়িত্বভার বহন করে চলেছেন। এখন তার বয়স ৭২ পূর্ণ হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনটি মেয়াদ পূর্ণ করে চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বছর চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক নিউজ উইকের মতে, বিশ্বের ১০ জন ক্ষমতাধর ব্যক্তির অন্যতম শেখ হাসিনা। দৃশ্যত বাংলাদেশে তিনি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’। সামরিক শাসকদের মতো হঠাৎ করে তিনি এই জায়গায় পৌঁছাননি। এ জন্য একটা দীর্ঘ ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। অন্য যে নয়জন ক্ষমতাধরের কথা নিউজ উইক বলেছে, তাদের মতোও নন শেখ হাসিনা। তার মতো রক্তরঞ্জিত পিচ্ছিল পথ তাদের পেরোতে হয়নি। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে, জীবন বাজি রেখে তাকে চলতে হয়েছে। অন্তত ১৯ বার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে পরাভূত করেছেন তিনি। তিনি শেখ হাসিনা। একাধারে মহাকাব্যের এবং ট্র্যাজেডির নায়িকা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একমাত্র বোন রেহানা ছাড়া আর সবাইকে হারালেন তিনি।
কত বয়স ছিল তখন শেখ হাসিনার? মাত্র ২৮ বছর! তিনি কি ভেবেছেন, তিনি হবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী? আমরা কি ভেবেছি? না, তিনি বা আমরা কেউই ভাবিনি।কেউ কি ভেবেছেন, এত বড় বিয়োগান্ত ঘটনার পর আওয়ামী লীগ আবার উঠে দাঁড়াবে? বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে? গ্রিক ট্র্যাজেডির মতোই বঙ্গবন্ধুকে, ইতিহাসের মহানায়ককে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। ট্র্যাজেডিতে তো তা-ই হয়। অথচ ঘটনাক্রমে বেঁচে যাওয়া, এই মহাকাব্যের, ট্র্যাজেডির নায়িকা হতে হলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। বিষয়টা আনন্দের না। বিষয়টা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া না। বিষয়টা নিয়মতান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো না। বিষয়টি ঝড়ের খেয়ার মতো। দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ নেই যে, শক্ত হাতে হাল ধরে ঝড়ের খেয়াটিকে তীরে ভেড়াতে পারে।
‘৭৫-এর শূন্যতার সুযোগ নিয়েছে মোশতাক-জিয়া-সাত্তার-এরশাদ-খালেদা। তাদের মদদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা। সবাই চেয়েছেন ইতিহাসের পিঠে সওয়ার হয়ে ‘অমরত্ব’ লাভ করতে। কিন্তু ইতিহাস কাঁধ থেকে সবাইকে নামিয়ে দিয়েছে। ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। ইতিহাস অপেক্ষা করেছে একজন নির্মাতার। যে ইতিহাসের পিঠে সওয়ার না হয়ে ইতিহাস নির্মাণ করবেন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সেই কাজটি করেছে। তার অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে দলের কাণ্ডারিরূপে গ্রহণ করেছে। ওই যে বললাম, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। বলেছি, বিষয়টি আনন্দের ছিল না। প্রস্তাবটি এসেছে অপারগতা থেকে। প্রস্তাবটি এসেছে অসহায়ত্ব থেকে। শেখ হাসিনা রাজি না হলে কী হতো? ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। দুটি শিশুসন্তানকে বিদেশে রেখে তিনি ইতিহাসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে দেশে চলে এসেছিলেন। কেন? না, কোনো ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণ করতে না। না, তিনি কোনো থ্রিলারের হিরোইন ছিলেন না। এসেছিলেন জাতির পিতার রক্তের ঋণ পরিশোধ করার জন্য। এসেছিলেন ‘৭৫-এর রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণ করার লক্ষ্যে। ক্ষমতার মোহে নয়, এসেছিলেন পিতার অসমাপ্ত কর্তব্যভার পালন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। এসেছিলেন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে নিতে। এসেছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে ভালোবেসে। এসেছিলেন এ কথা ভেবে, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ-যে রাত্রি এখানে থেম না’- অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে। যারা তাকে কথায় বা ইঙ্গিতে জীবনের ঝুঁকির কথা, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাদের কথার উত্তরে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন- ‘আমি ভয় করবো না ভয় করবো না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’ তারপর ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে, চিত্ত ভাবনাহীন শেখ হাসিনা এগিয়ে গিয়েছেন।’ আর ইতিমধ্যে পার করে দিয়েছেন অর্ধেক জীবনেরও বেশি। দল বা দেশ চালাবার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ছিল না কোনো পূর্বপ্রস্তুতি। যখন তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন পরিস্থিতি ছিল চরম প্রতিকূল। আওয়ামী লীগ করাটাই সে সময়ে ভয়ের কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু। সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, দল ভাঙার খেলা। দলের অভ্যন্তরে নানা উপদলীয় কোন্দল। জনগণের মধ্যে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি। বড় নেতাদের কারও কারও উদ্যোগে একাধিকবার দল ভেঙে দল করা।
সর্বোপরি গ্রেফতার, নির্যাতন ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২৩ জনের জীবনহানি। তার জীবনাচার ও স্বভাবের লোকঐতিহ্য- সহজ-সারল্য, একদিকে যেমন বাংলার গরিব মেহনতি মানুষ ও মধ্যবিত্ত সমাজকে ভাবিয়েছে যে, ‘ও তো আমাদেরই লোক, আমাদের ঘরের মেয়ে’; তেমনি এই সহজ-সারল্যকে অনেকে দুর্বলতাও ভেবেছে। এ জন্য এলিট শ্রেণির লোকেরা কটুকাটব্য করেছে। কিন্তু দিনের শেষে বিজয়ের বরমাল্য তিনিই পেয়েছেন। যেমন দল পরিচালনায়, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় তাকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। জানতে হয়েছে। বুঝতে হয়েছে। সহকর্মীদের ও কর্মীদেরও শেখাতে, জানাতে ও বোঝাতে হয়েছে। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলো হূত জনপ্রিয়তা ফিরে পেয়েছে। নতুন করে দৃঢ় ভিত্তির ওপর শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উপদলীয় প্রবণতা দূর হয়েছে। দলের মধ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে লাগাতার গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এরশাদ-খালেদা স্বৈরাচারের দুঃশাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ গঠনের প্রধান বাধাগুলো দূর করা তার নেতৃত্বের গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যের বর্ণনা দিতে হলে এক মহাভারত রচনা করতে হবে। শেখ হাসিনার সাফল্য হচ্ছে, বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামনে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
কেউ কেউ মনে করেন, ‘ক্ষমতা’ হচ্ছে উপভোগ করার বিষয়। যারা এটা মনে করেন, তাদের কাছে এ দেশে খালেদা-এরশাদের মতো অসংখ্য নজির আছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও গোষ্ঠীস্বার্থে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত ওরা স্থাপন করেছেন, তা থেকেই মানুষের এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত এসব একদার ক্ষমতাবানদের বিপুল সম্পদ, বিলাসী জীবনযাপন, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে জনগণের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে; কিন্তু শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে বহুভাবে চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করেছে এক-এগারোর পরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, শেখ হাসিনার এবং তার পরিবারের ‘অবৈধ বিষয়-আশয়, সহায়-সম্পদ’ খুঁজে বের করতে। দেশে-বিদেশে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু তারা হতাশ হয়েছেন। যা নেই তা তারা খুঁজে পাবেন কীভাবে? কোনো দুর্নীতি ও ভোগ-বিলাসিতার মালিন্য তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের (তার ভাষায়, আমার পরিবার হচ্ছে আমার সন্তান ও আমার বোন রেহানার সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ) স্পর্শ করতে পারেনি। এটা একটা বিরল দৃষ্টান্ত। শেখ হাসিনার সতীর্থ, যারা পরস্পরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কমবেশি জানি, এক ঘরোয়া আড্ডায় কথা উঠেছিল আমাদের মধ্যে কে কে সুখী, কে অসুখী। খুবই স্পর্শকাতর ও একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কিন্তু আমাদের ‘সতীর্থ ৭১’-এর আড্ডায় সেদিন যে যার মতো করে হাসি-তামাশার মধ্যে এর উত্তর দিয়েছি। হঠাৎ আমাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠল, হাসিনা কি সুখী? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর, তিনি তো আর এই আড্ডায় নেই। একবার মাত্র গণভবনে এই আড্ডা হয়েছিল। সাহস করে আমি বললাম, পিতা-মাতা, ভাই-ভ্রাতৃবধূদের এমন ট্র্যাজিক মৃত্যুর পরও একজন মানুষ কি সুখী হতে পারে? আমাদের মধ্যে স্তব্ধতা নেমে এলো। পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন গেয়ে শোনালাম- ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে…।’ গান থামিয়ে বললাম, ‘এ দেশে জন্মে, এ দেশকে ভালোবেসে যে তার জন্মকে সার্থক মনে করে, তার মতো সুখী আর কে হতে পারে? হাসিনা সুখী। কারণ তিনি এ দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দেশকে ভালোবেসেছেন।’ দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পিতৃহত্যার রাজনৈতিক প্রতিশোধ তিনি নিয়েছেন। বেবী মওদুদ, জাহানারা নিশি এবং বাদলসহ অনেকেই আমাকে সোচ্চার সমর্থন জানালেন। সবার অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী আমাদের প্রয়াত সতীর্থ জাহানারা নিশি দরদি কণ্ঠে পুরো গানটা গাইলেন। পিনপতন নীরবতার মধ্যে
যখন ওর গান শেষ হলো, তখন সবার চোখের কোনায় জল…।