গুনগুন পর্ব: (লালবাগ স্কুল)
প্রকাশিত : বুধবার, ১০ জুন ২০২০ ইং ।। ২৭ই জ্যৈস্ঠ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক :
ঝর্না রহমান
শিশু জন্মের পর কেঁদে উঠে প্রথম তার উপস্থিতি জানান দেয়। আমার ধারনা, জন্মের পর আমি গান গেয়ে উঠেছিলাম, কিংবা আমার মা গান গেয়ে উঠেছিলেন, অথবা কোনো পাখি গেয়ে উঠেছিল বা কোনো পাহাড়ি ঝরনা! মোট কথা আমার জন্মের সময় কোনো না কোনোভাবে গানের একটা শুভযোগ ঘটেছিল তা নইলে গান আমি এত ভালোবাসবো কেন?
আমি জন্মেছিলাম ১৯৫৯ সনের ২৮ জুন তারিখে*, ৩৯ নবদ্বীপ বসাক লেনের ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায়। ধাত্রী হিসেবে আমার মায়ের পাশে ছিলেন হাতুড়ে দাই আর আম্মার শুভার্থী প্রতিবেশিনীগণ। আম্মার কাছে শুনেছি, তাঁরা অবাক হয়ে আমার শ্যামাঙ্গিনী জননীর গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া বরফজাদীর মতো এক ধবধবে শিশুকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। হয় তো তাঁরাই হাতে হাতে ধরে আমাকে ঘিরে গেয়ে উঠেছিলেন ‘খুকুমনি জনম নিল যেদিন মোদের ঘরে…।’ আম্মার কাছে শুনেছি, সেদিন চারপাশে ঝরছিল শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহের বৃষ্টিধারা। হয়তো প্রকৃতিও সেদিন তার জলের সেতারে গান গেয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল। তখন হয়তো কোন দূরান্তে স্রোতলহরীর সংগীতধ্বনির মধ্যে আমার জন্য নাম পাঠিয়ে বয়ে গিয়েছিল কোনো ঝরনা!
কত ছোট বয়স থেকে আমি গানকে ভালোবেসেছি? অনেক ছোট! তখনও আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। তখনও আমাদের রেডিও হয়নি। তখনও আমি কোনো সিনেমা দেখিনি! কিন্তু আম্মাকে দেখতাম, আমার ছোট বোনকে কোলে নিয়ে ‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি’ গাইতেন! মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করে গাইতেন, ‘মন ডোলে মেরা তন ডোলে’ আর ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরে লাল দোপাট্টা মলমল কাহোগি!’ একটু বড় হয়ে ওঠার পর আম্মার মুখে একটা অন্যরকম গানের কলি শুনলাম! ‘কৃষ্ণচূড়া আগুন তুমি আগুন ঝরা বাণে, তুণ করেছ শূন্য তোমার গুণ করেছ গানে!’ শূন্য’ আর ‘গুণ’ শব্দে গিয়ে আম্মা গলার ভেতরে কেমন দুষ্টু দুষ্টু সুরের ধাক্কা দেন। এই সুর আর ধ্বনির দোলাটাই আমার মাথায় প্রথম গানের শব্দতরঙ্গ হিসেবে ঢুকে গেল। সেই ঢেউ আমাকেও ছোট ছোট ধাক্কা দিতে শুরু করলো। যেখানেই গান শুনি আমার কান হরিণের মত খাড়া হয়ে ওঠে। ভালো লাগে সুর, ভালো লাগে শিল্পীর গলার ওঠানামা। কিন্তু স্কুলের চৌকাঠে পা রাখার আগেই আম্মা আমাকে তুমুল বেগে শেখাতে লাগলেন কবিতা। কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি, বাবুদের তালপুকুরে, ও মা তোমার বাবার নাকে, আমাদের ছোট নদী, এক যে ছিল সাহেব তাহার, ঝিকিমিকি করে জল সোনালি নদীর, বাঁশবাগানের মাথার ওপর….. শিখিয়ে পড়িয়ে আমার মাথার ওপর রবীন্দ্র-নজরুল-সুকুমার-অচি
১৯৬৪ সনে আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হলাম। থাকি তখন আজিমপুর শাহসাব বাড়িতে ভাড়া বাসায়। আব্বা একদিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে গেলেন লালবাগ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলে। স্কুল প্রাঙ্গণে পা রেখে আমার বুক দুরু দুরু করতে লাগলো। বাপরে! এত বড় বিল্ডিং! এত ছাত্রী! এতরকম কর্মকাণ্ড! হা করে দেখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ি আর কি! আব্বা বললেন, কী রে, স্কুল পছন্দ হয়েছে? ঠোঁট ফুলে ওঠে আমার। এখানে তো আমি হারিয়ে যাবো! কাঁদতে শুরু করলাম। স্কুলে পড়বো না আব্বা! আব্বা আদর করে বোঝালেন, স্কুল অনেক মজার জায়গা। কত নতুন বই পড়া হবে। খেলাধুলা হবে। সবাই আমাকে ভালোবাসবে। ইত্যাদি। আব্বা আমাকে হেড মিস্ট্রেসের রুমে নিয়ে গেলেন। এখানেও আব্বা হেডমিস্ট্রেসের কাছে আমার ‘কবিতা বলা’ গুণপনা জাহির করে দিলেন। সুতরাং বড় আপামনির সামনে আমি কয়েকখানা ‘কবিতা বললাম’। তাতেই হয়ে গেল! একটু লিখতেও দিলেন বড় আপা। আর হাতের লেখায় আমি সত্যিই তাক-লাগানো চৌকস! আম্মা আমাকে শুধু কবিতায় নয়, লেখায়ও রীতিমত দিগগজ করে তুলেছিলেন। ছয় বছরের চৌকাঠ না-পেরুনো এক শিশুর এত বিদ্যের তো অপচয় হতে পারে না! হেড মিস্ট্রেস আমাকে একবারে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নিলেন! তরতর করে ক্লাস চলতে লাগলো। তবে ক্লাস তেমন ভালো লাগে না, আমার খুব ভালো লাগে স্কুলে সকাল বেলার অ্যাসেম্বলি। কারণ সেখানে সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে গান করে। গান মানে একটি প্রার্থনা সংগীত (গোলাম মোস্তফা রচিত), হে খোদা দয়াময় রহমান রহিম, হে বিরাট হে মহান হে অনন্ত অসীম। আর দুটি জাতীয় সংগীত, প্রথমে পাকিস্তান জিন্দাবাদ এবং পরে পাকসার জমিন সাদবাদ, কিসওয়ারে হাসিন সাদবাদ। প্রার্থনা হোক, জাতীয় সংগীত হোক, গান তো! আমি পরম যত্নে গলা খেলিয়ে গান গাই। কিন্তু কথা তো সব বুঝি না! প্রার্থনা সংগীতটিতে ‘হে বিরাট হে মহান হে অনন্ত অসীম’-কে গাচ্ছি ‘হেবিরা হেমাহা হেয়ানান তায়াশিম’, আর এক জায়গায় ‘তুমি মুক্ত স্বাধীন, বাধাবন্ধনহীন, তুমি এক তুমি অদ্বিতীয় চিরদিন’Ñএখানে শেষ লাইনটিকে গাইছি ‘তুমিও তুমিও দ্বিতীয় চিরদিন’ (হায় অদ্বিতীয় প্রভু, এই নাবুঝ বান্দার অজ্ঞতা তুমি ক্ষমা কোরো!)! আর জাতীয় সংগীত? নাজির আহমেদ রচিত ও আব্দুল আহাদ সুরারোপিত পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের বাংলা রূপটির মধ্যে অনেক শব্দ ছিল যে সব শব্দ আমাদের দেশ জনপদ প্রকৃতি বা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ‘যেমন পুরব বাংলার শ্যামলিমা, পঞ্চনদের তীরে অরুণিমা, ধূসর সিন্ধু মরুসাহারা, পেলো আযাদীর স্বাদ।’ এখানে গাইতাম, পনচা না দের তীরে অরনি মা, আবার ‘খাইবার দ্বারে দ্বারে পতাকাবাহী, মেঘনার কূলে যত বীর সিপাহী, প্রাচ্য প্রতীচ্যের মিলন গাহি, ঝাণ্ডা জাগিছে আযাদ’, এ অন্তরায় গাইতাম ‘খাইবার দ্বারে তার পতাকা বাহির’ ( মানে মনে করতাম, খাওয়ার ঘরের দরজার বাইরে পতাকা উড়ছে! নদী বিধৌত শস্য-শ্যামল সমতল বাংলার এক বালিকা কী করে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংযুক্ত পার্বত্যসীমান্তের খাইবার গিরিপথের নাম জানবে বা ভাববে! )! আবার আর-এক অন্তরাÑ ‘সাম্য মৈত্রীর বন্ধনহার, তৌহিদী দীক্ষা কণ্ঠে যাহার, তিস্তা-বিতস্তা আজও মুছে দেয় গ্লানি দুঃখ বিষাদ’, এখানে গাইতাম তিস্তা গো তিস্তা! (এক নাদান ছোট্ট বালিকা তখনও বাংলাদেশের তিস্তা নদীর নামই ভালো করে শোনেনি, পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর অপর নাম বিতস্তা নদী সেটা কী করে জানবে? যাই হোক, গানের কথা বা পঙক্তি বিন্যাস হয় তো এখনও ঠিক হল না, অন্তরাও হয়তো আগে পিছে হোল। স্মৃতি খুঁড়ে এটুকু বের করতেই আমার ঘাম বের হয়ে গেল।) বাংলা গানের পরে পাকিস্তানের মূল জাতীয় সংগীত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। সেটা তো বাংলাও না। তখন জানতাম এটা ঊর্দু। কিন্তু হাফিজ জলন্ধরী রচিত ও আহমেদ গোলাম আলী সুরারোপিত এই গানটি আদতে ফারসি ভাষায় রচিত। বাংলাভাষাভাষী শিশুরা নিশ্চয়ই সেই গানের কথার মাথামুণ্ড কিছু না বুঝেই গাইত! এখনও মনে পড়লে হাসি পায়, কী যে গাইতাম! সে যা-ই গাইতাম, শত শত শিক্ষার্থী এক সুরে এক সাথে গান করছে, সমবেত কণ্ঠের একটা মোহময় ঐকতান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে অনেক দূর, এটি আমার খুব ভালো লাগতো। অ্যাসেম্বলি শেষ হলেও আমার কানে লেগে থাকতো সেই গান, সেই সুরের দোলা, সারাক্ষণ গুনগুন করে গাইতাম। বাসায় এসে ছোট বোন ও খেলার সাথিদের নিয়ে স্কুল-স্কুল খেলা খেলতাম। দু হাতে মোনাজাত ধরে গাইতাম, হে খোদা দয়াময় রহমানো রহিম, হেবিরা হেমাহা হেয়ানান তায়াশিম, তুমি মুক্ত স্বাধীন, বাধাবন্ধনহীন, তুমিও তুমিও দ্বিতীয় চিরদিন….! (চলবে)
ঝর্না রহমান
৭ জুন ২০২০
*(এটি আমার সার্টিফিকেট তারিখ। আমার ধারণা সনটা হবে ১৯৫৮। সম্ভবত সার্টিফিকেটে আমার বয়স এক বছর কমিয়ে লেখা হয়ছে! আমার বাবামায়ের বিবাহের সন ১৯৫৭। কাজেই ৫৮-এর আগে জন্মবার সুযোগ নেই আমার। ‘সার্টিফিকেট এজ’ নামের একটা অশুভ সংস্কৃতি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জীবনের শুরুতেই একটা অনাকাক্সিক্ষত মিথ্যা স্বীকৃতির সিল মেরে দেয়! খুব খারাপ বিষয় এটি। জননী জীবনে এসে আমি আমার তিন সন্তানের জন্ম তারিখকে এই অশুভ সংস্কৃতির ছোবল থেকে রক্ষা করতে পেরেছি!)
ছবি: ২০১৫ সনে প্রকাশিত নিজের লেখা ও স্বকণ্ঠে গাওয়া আমার প্রথম গানের অ্যালবামের কভার।
================ অধ্যাপক ঝর্না রহমান ==============
বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের কেওয়ার গ্রামে। ঝর্না রহমান একজন কথাসাহিত্যিক,কবি ও সংগীত শিল্পী। চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি লেখালিখির সাথে জড়িত।
গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধনিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। চারটি সম্পাদনা গ্রন্থসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার ভ্যাংক্যুভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য Trevor Carolan সম্পাদিত দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন The Lotus Singers গ্রন্থে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত পাঞ্জাবী সাহিত্যিক অজিত কৌর আয়োজিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে একাধিকবার সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।
পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা। অবসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র লেখালিখি। ঝর্না রহমান একাধারে একজন গীতিকার সুরকার এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী।
এ ছাড়া তিনি কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ পরণকথা এবং অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের মুখপত্র ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর সম্পাদনা করেন ।
তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই:গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা,নাগরিক পাখপাখালি ও অন্যান্য,পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী,নিমিখের গল্পগুলো,বিপ্রতীপ মানুষের গল্প,বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনূদিত গল্প) ,তপতীর লাল ব্লাউজ, উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা। কাব্য: নষ্ট জোছনা নষ্ট রৌদ্র, নীলের ভেতর থেকে লাল, জল ও গোলাপের ছোবল, জলজ পঙক্তিমালা, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়। কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি, নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী, প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: সেঁজুতি, রৌদ্রজলের গদ্য।
মা:রহিমা বেগম,বাবা:মোঃ মোফাজ্জল হোসেন,গ্রামের বাড়ি:কেওয়ার,মুন্সিগঞ্জ। জন্ম:২৮ জুন,১৯৫৯।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।