রুপালি পর্দা দুলে ওঠে: (গনাইসার)
প্রকাশিত : বুধবার,২৪ জুন ২০২০ ইং ।। ১০ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক :
অধ্যাপক ঝর্না রহমান
গোঁফওয়ালা একজন ফুলকুমার টাইপ নায়ক চাঁদের দেশের রাজকন্যার মত এক নায়িকার সাথে বাগানে রেলিং ধরে (পরে দেখেছি, বাগান না, ওটা ছিল খুব সম্ভবত কোলকাতার গঙ্গার ধারের ফুটপাথ ) গান গাইছেন, আর রেলিঙের নিচে দাঁড়িয়ে সেই চাঁদকুমারী লাজরাঙা মুখে আঁচল পেঁচাচ্ছেন ~ এই দৃশ্যটি আমার ‘সিনেমা দেখা জীবনের’ তোলপাড় করা এক স্মরণীয় স্মৃতি। কারণ এটি ছিল আমার জীবনে দেখা (১৯৬৮ সনের কোনো এক দিন।) প্রথম সিনেমা। অবশ্য আরও আগে আব্বা আম্মার সাথে দেখেছিলাম ভারতীয় বাংলা ছবি ‘মায়ামৃগ’। তথ্যের দিক থেকে সেটিই প্রথম, তবে সে সময় অনেক ছোট ছিলাম বলে সে সিনেমার স্মৃতি আমার মনে নেই। যাই হোক, ফুলকুমার আর চাঁদকুমারী নায়কনায়িকাদের সিনেমার নাম ‘লুকোচুরি’। কিশোর কুমার নায়ক। তার ডবল পার্ট। এক কিশোর কুমার যমজ ভাই রূপে দুই নায়ক হয়ে দুই বোনের সাথে প্রেম করে। দুই বোনের একজন মালা সিনহা, অন্যজন অনিতা গুহ। খুব মজার সিনেমা। সারা সিনেমা জুড়ে দুই বোনের প্রেমিক অদলবদলের ধুন্দুমার সমস্যা আর বিয়ের আসরে বর পালানোর দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু পুরো সিনেমার মধ্যে ঐ একখানা দৃশ্য আমার চোখে একেবারে আঠা হয়ে লেগে গেল শুধু গানটার জন্য! গানটি ছিল ‘মায়াবন বিহারিণী হরিণী গহন স্বপন সঞ্চারিণী।’ অদ্ভুত সুন্দর এক মায়াময় পরিবেশ রচনা করেছিল এই গান। সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আব্বা। হল থেকে বের হয়ে আব্বা বললেন, কিরে বাবা, সিনেমা দেখতে কেমন লাগলো? আমি তখন সিনেমা দেখার আনন্দে যেন পরীর রাজ্যে উড়ে বেড়াচ্ছি। কেমন হালকা লাগছে দেহ। রোমকূপের ভেতর থেকে যেন ঝুমঝুম করে পালক বেরিয়ে আসছে! বললাম, খুব ভালো! আব্বা বললেন, গানটা কেমন লাগলো? শিং নেই তবু নাম তার সিংহ! আব্বা কপালের ওপরে দু আঙুলে দুটো শিঙ বানিয়ে নাচান। আমি মিন মিন করে বললাম, না, ঐ গানটা বেশি ভালো লেগেছে। আব্বা বলেন, ও, পুতুল নিয়ে গানটা? এক পলকে একটু দেখা? আব্বা হয়তো মনে করেছিলেন, বাচ্চাদের কাছে তো টেবিলের ওপর নুন আর চিনি ভরা গুটলু গুটলু পুতুল শেপের পট দুটো নাচিয়ে কিশোর কুমারের অসাধারণ মজা করে গাওয়া গানটাই সবচেয়ে ভালো লাগবে! তাই আব্বাও মজা করে লাইনটা একটু গেয়ে উঠলেন। আমি একটু লজ্জিত হয়ে বললাম, না, ঐ যে, মায়াবনবিহারিণী হরিণী! কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এটা বড়দের গান। রোমান্টিক প্রেমের গান। আব্বা একটু অবাক হয়ে আমাকে দেখলেন। বললেন, ঐটা? অ! হ্যাঁ, ঐটাও সুন্দর। তবে ঐটা হল রবীন্দ্র সংগীত!
রবীন্দ্র সংগীত! দশ বছরের বালিকা আমি রবীন্দ্র সংগীতকে তখনও ভালোবাসতে শিখিনি। তবে রেডিও শুনতে শুনতে রবীন্দ্র সংগীত যে গানের একটা আলাদা শ্রেণী এটা বুঝেছিলাম। কিন্তু এই শ্রেণীর গানগুলোকে মনে হত বেশি স্লো। মনে হত শিল্পীরা গানের কথাগুলোকে কেমন আলুর মত গোল গোল করে গায়! রবীন্দ্র সংগীত হলে তাই রেডিওর কান মুচড়ে বন্ধ করে রাখতাম। আর লালবাগ স্কুলে যে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ চুরি করে লেখার জন্য শাস্তি পেয়েছিলাম, তখন ঐ গানকে শুধু গান বলেই জেনেছি। রবীন্দ্র সংগীত বলে জানিনি। ‘লুকোচুরি’ সিনেমায় ব্যবহৃত রবীন্দ্র সংগীতটি যেন আমাকে এক ধাক্কায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ের কাছে নিয়ে ফেললো! কী সুন্দর গান! কী সুন্দর সুর! গানের ভেতরে কী সুন্দর ছবি জেগে ওঠে! আর মনের ভেতরে কী কী সব কাÐ ঘটে যায়! মায়াবনবিহারিণী গেয়ে গেয়ে আমার মন ভরে না। এক জাদুর বাঁশরীর সুর যেন আমার মনটাকেও পরশ করে আমাকে বিবশ করে ফেলে!
লুকোচুরি সিনেমা দেখার পর একেবারে ধাঁ করে সিনেমার তিয়াস বেড়ে গেল। গানের মধ্যে সেরা গানগুলো তো সিনেমারই! সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই রেডিওতে অনেক গান প্রচারিত হতে থাকে। সেসব গান শুনে ছবিটি দেখার জন্য মন আকুলিবিকুলি করতে থাকে। ১৯৬৭-র মাঝামাঝি থেকে ৬৯ সন পর্যন্ত ঝাড়া আড়াই বছর আমার লেখাপড়াও চাঙ্গে তোলা রইল। মগজের খোপগুলো সব ফাঁকা! ওখানে কেবল গান ঢুকতে লাগলো, সিনেমার গল্প ঢুকতে লাগলো। আব্বা থাকেন ঢাকায়। সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ি আসেন। মাঝে মাঝে নানা উপলক্ষে সরকারি ছুটি। মাঝে মাঝে ঢাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। সে কারণেও চলে আসেন বাড়িতে। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে উঠছিল তখন। সে সময় একদিন ‘হরতাল’ শব্দটি শোনা হল আমাদের। আব্বা বলেন আওয়ামী লীগ ন্যাপ আরও কিছু রাজনৈতিক দল হরতাল ডেকেছে। হরতাল মানে হল ‘হর ঘরে তালা’! সব বন্ধ! অফিসও বন্ধ আব্বা? হ্যাঁ অফিসেও তালা! আমরা নেচে উঠি। কী মজা! তা হলে রোজ হরতাল হোক! হরতালের পেছনে জনগণের প্রতিবাদ থাকে বিক্ষোভ থাকে, এসব আমরা শুনি না! তৎকালীন সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনে ছাত্র জনতা মিছিল মিটিং করতে গেলেই মার খাচ্ছিল। মরেও যাচ্ছিল। দলে দলে ওদের নিয়ে ঢোকাচ্ছিল জেলে। জুলুম করছিল। কিন্তু এসবের তখন আমরা কী বুঝি! আমাদের ছোট মাথায় এইসব রাজনৈতিক সমস্যাসংকট ঢুকতেও পথ পায় না। আমরা ওসব নিয়ে ভাবি না। বরঞ্চ আব্বা বাড়ি এলে আমরা কী কী আনন্দ করবো তাই নিয়ে ভাবি। বাড়ি আসার পরে ভাবি কী করে আরও আনন্দ পাওয়া যাবে। সেটা হবে আব্বার সাথে ঢাকায় বেড়াতে গেলে, সিনেমা দেখতে পেলে। সুতরাং নতুন কোনো ছবি রিলিজ হলেই আমরা আব্বার কাছে সিনেমা দেখার জন্য ঝুলোঝুলি শুরু করি। আব্বার সাথে আমি বা বোনেরা মাঝে মাঝে আমি ঢাকায় চলে আসতাম। আব্বার ‘মেসে’ বেড়াতেও আমার খুব ভালো লাগতো! সে সময় আব্বা থাকতেন নাখালপাড়া একটা মেসবাড়িতে। আমাকে মেসে রেখে আব্বা অফিসে চলে যেতেন। আমি একা একা মেসের গৃহকর্মী মহিলার রান্নাবাড়া কোটা বাছা দেখতাম, জমানো খবরের কাগজগুলো পড়তাম, ঘরের পাশ দিয়েই রেললাইন চলে গেছে। খানিক পর পর সিটি বাজিয়ে ট্রেন চলে যেত! জানালা দিয়ে তাকালে অনতিদূরে লোহার তৈরি সাপটাকে সত্যিকারের সাপের মত গা মুচড়ে চলে যেতে দেখতাম। খুব ভালো লাগতো আমার। ঢাকায় এভাবে আব্বার মেসেই বেড়াতাম। আব্বা আমাকে নানা জায়গা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার পরের সপ্তাহে বাড়ি নিয়ে যেতেন। তবে আব্বাকে দিয়ে আগেই কড়ার করিয়ে ফেলতাম, সিনেমা দেখাতে হবে! আব্বা নিজেও সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি আব্বার সাথে যত সিনেমা দেখেছি তত আর কারো সাথে দেখিনি। তখনকার চলচ্চিত্রগুলো পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মত ছিল! কত সিনেমা আব্বা আমাদের দেখিয়েছেন! বেশিরভাগ দেখতাম আব্দার করে, আবার আব্বা কোনো কারণে বকা দিয়ে বা কড়া শাসন করে পরে কমপেনসেশন হিসেবেও সিনেমা দেখিয়েছেন।
গনাইসার গ্রামে থাকাকালীন আব্বা ‘লুকোচুরি’র পরের সিনেমা দেখালেন, স্বর্ণকমল (১৯৬০)। আহ! সেই সিনেমা দেখে তো একেবারে মুগ্ধ বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম। (এখনকার চোখে দেখলে সে সিনেমার পিকজারাইজেশন হয়তো খুবই হাস্যকর মনে হবে।) মাতৃহারা অসহায় বালিকা রাজকন্যা স্বর্ণকমল সৎ মা কুচুটে রানীর চক্রান্তে পড়ে দাসী হয়ে গেল। রানী তাকে কুয়োতলায় বড় বড় ডেগডেগচি ধুয়ে সাফ করতে পাঠালো। এক ঢাকনা মাজতে গিয়েই রাজনন্দিনী কালিঝুলি মেখে ভূত। কাঁদতে কাঁদতে গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়লো সেখানেই। আর তা দেখে আসমান থেকে স্বর্ণকমলের মায়ের আত্মা নেমে এসে হাতের ইশারায় সব ডেগডেগচি মুহূর্তে মেজেঘসে ঝকঝকে করে রেখে গেল। রাজকন্যা স্বর্ণকমলের কেঁদে কেঁদে গাওয়া সেই গান শুনতে গিয়ে হলের মধ্যে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম আমি। আব্বা আস্তে করে বললেন, কিরে বাবা, পানি খাবি? আমি লজ্জায় তাড়াতাড়ি চোখ মুছি। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া সেই গান আমাকে পাগল করে ফেলে। গানটা ছিল, কোথায় আছো তুমি মা, কেঁদে কেঁদে ডাকি তোমায়, তবু কেন মাগো শোন না। বাড়ি ফিরে এসে স্বর্ণকমল সিনেমার আদ্যোপান্ত গল্প রীতিমত অভিনয় করে, ডায়লগের জায়গায় ডায়লগ আর গানের জায়গায় গান গেয়ে আমি ছোট বোনদের কাছে বয়ান করি। শুধু স্বর্ণকমল নয়, বিয়ের আগ পর্যন্ত যত সিনেমা আমি একা দেখেছি, কিন্তু অন্য বোনরা দেখেনি, বাসায় ফিরে আয়োজন করে ওদের কাছে সেসব সিনেমার অনুপুঙ্খ গল্প বর্ণনা করতাম আমি। সিনেমা চলতো তিন ঘণ্টা, কিন্তু সিনেমার কাহিনী বর্ণনা করতে আমার তিনের জায়গায় চারপাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। গল্প করতে গিয়ে আমার মনে হত আমি যেন চোখের সামনে সে দৃশ্যগুলো দেখতে পাচ্ছি, সে গানগুলো শুনতে পাচ্ছি। সত্তর দশকের মধ্যে বাংলা সিনেমার অসাধারণ সুন্দর সব গান বাংলাদেশের গানের ভাণ্ডারকে ভরিয়ে তুলতে থাকে। এক একটা সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই তার গানগুলো বাজতো রেডিওতে। আর থাকতো সিনেমার রেডিও-বিজ্ঞাপন!* বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের সেই ‘হ্যাঁ ভাই’ সম্বোধনে জাদুকরী কণ্ঠের অধিকারী মাজহারুল ইসলামের সিনেমার বিজ্ঞাপনের কথা আজও মনে পড়ে!
এর মধ্যে আরও কটি দারুণ দারুণ সিনেমা দেখা হয়ে গেল আমার। বেশিরভাগই ফ্যান্টাসি। আমার জগৎ তখন রূপকথারই জগৎ। নিজেকে মনে হয় স্বপ্নের কোনো জগৎ থেকে পথ ভুল করে আসা মেয়ে, পিঠের মধ্যে যেন দুটি ডানাও আছে আমার! সুতরাং আমার ভালো লাগে সুয়োরানি দুয়োরানি, পাতালপুরীর রাজকন্যা, সাতভাইচম্পা, অরুণবরুণকিরণমালা। এসব ছবির কয়েকটা গান তখন সবার মুখে মুখে ফিরতো। ওলো সুন্দরী তুই জলদি আয় পাক কইরা দে খিদায় পরান যায় (শাহনাজ বেগম আব্দুর রউফ), শোনো শোনো কন্যা ওগো কন্যা মনের কথা বলি (শাহনাজ বেগম আব্দুর রউফ), শুনেন শুনেন জাহাপনা শুনেন রানী ছয়জনা (শাহনাজ বেগম), ও সাত ভাই চম্পা জাগো রে (শাহনাজ বেগম), খা খা খা বক্ষিলারে কাঁচা ধইরা খা (সাবিনা ইয়াসমিন ও সৈয়দ আ. হাদি) ইত্যাদি। তখন চলচ্চিত্রের বুকলেট পাওয়া যেত। আমি কয়েকটা বুকলেটও জোগাড় করে ফেলেছিলাম। সব গান সেখানে থাকতো। মনে হত সোনার খনি। তবে, জনপ্রিয় গানগুলোই রেডিওতে বেশি বাজতো বলে সেসব আমার মুখস্থ থাকতো। আর অন্য গানগুলো শোনার সুযোগ হত না। মায়ার সংসার (১৯৬৯) অবাঞ্ছিত (১৯৬৯) এ দুটো সামাজিক ছবিও সেই শৈশবেই দেখি। অসাধারণ সুন্দর গানে ভরা দুটি ছবিই। মায়ার সংসার ছবিতে আব্দুল জব্বার ও সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ওগো লাজুকলতা শুধু এই লগনে, সাবিনা ইয়াসমিনের একি চঞ্চলতায় মন ভরেছে, অবাঞ্ছিত ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিন ও বশীর আহমেদের গাওয়া প্রিয়তম তুমি এলে, সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ওরে মন পাপিয়া, আব্দুল জব্বারের ও দেখা হল পথ চলিতে, কিংবা শাহনাজ বেগমের গাওয়া মন তুমি কেড়ে নিলে একি বিষম দায় রে…এ গানগুলো যতবার শুনি শৈশবের সেই দিনগুলো আমার সামনে ঝাঁপিয়ে চলে আসে। এখনকার শিশুকিশোররা এসব সিনেমা দেখা থাক দূরের কথা গল্প শুনেই হাসবে। এসব গান ওদের মধ্যে কোনো আগ্রহই জাগাতে পারবে না। এখকার শিশুদের শৈশব গড়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত ফ্যান্টাসি মুভি হ্যারি পটার সিরিজ, লর্ড অফ রিংস, প্যানস ল্যাবিরিনিথ ইত্যাদি দেখে। ওদের কল্পনার জগৎ অসাধারণ সব থ্রিডি ফোরডি মুভির বিস্ময়কর সব দৃশ্যে সাজানো। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আজকের দিনের মত ছিল না। গ্লোবাল ভিলেজ ধারনাই তখনো কল্পনায় আসেনি, গোটা দেশই ছিল একটা ছোট্ট সুন্দর শান্ত গ্রাম। প্রকৃতি আছে প্রযুক্তি নেই, নিজস্ব ~ একেবারে গ্রাম থেকে উঠে আসা সংস্কৃতি আছে, বিশ্বায়ন নেই, কৃষকের ফলানো মনোহর সব নামের ধান আছে, জিন বদলানো, সংখ্যা বসানো নামের শস্য নেই! তাই আামাদের শৈশবকে সেইসব সিনেমা আর গানগুলো রাঙিয়ে দিতে থাকে। এখনও মনে হয় এমন সরল সুন্দর কাহিনী আর অসাধারণ কথা সুরের গানেভরা রোমান্টিক চলচ্চিত্র আর তৈরি হবে না। ‘অবাঞ্ছিত’ ছবিতে সুজাতা রাজ্জাকের কোলে মাথা রেখে গাওয়া ‘প্রিয়তম তুমি এলে তুমি এলে জীবনে মধুময় লগনে’ ~ এ গানের দৃশ্যকে মনে হত গল্পের দেশের অসাধারণ রোমান্টিক দৃশ্য। গানে আর রোমাঞ্চে শিহরন জাগানো সেই সব ছবি।
গনাইসারে নানাবাড়িতে আমার শৈশব ভরে উঠতে থাকে স্বর্ণযুগের সব গানে। ভালো ভালো বাংলা ছায়াছবি যেমন নির্মিত হতে থাকে পাশাপাশি আব্দুল লতিফ, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আজিজুর রহমান, কেজি মোস্তফা, নইম গওহর, আ. আহাদ, সমর দাশ, ধীর আলী প্রমুখ স্বনামধন্য মেধাবী সব গীতিকার আর সুরকারদের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। তাঁদের সৃষ্টি সেরা সেরা আধুনিক গানগুলো তৈরি হতে থাকে তখন। আমার শ্রুতিতে মুদ্রিত হতে থাকে অসংখ্য আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান। কয়েকটা গান একটু উল্লেখ করি: সেই চম্পা নদীর তীরে (আবু হেনা মোস্তফা কামালের কথা ও নিজের সুরে আবুবকর খানের কণ্ঠে), পথে যেতে দেখি আমি যারে (আবু হেনা মোস্তফা কামলের কথা ও নিজের সুরে আনোয়াউদ্দীন খানের কণ্ঠে), লোকে বলে প্রেম আর আমি বলি জ্বালা (আনোয়ার উদ্দীন খানের কথা ও সুরে ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে) দুটি পাখি একটি নীড় একটি নদীর দুটি তীর (ফরিদা ইয়াসমিন ও মো. আলী সিদ্দিকী), সারাদিন বইছে বাতাস (ফরিদা ইয়াসমিন), না হয় রাখলে আমার কথা আগের মত (মাসুদ করিমের কথা ও খন্দকার নূরুল আলমের সুরে মো আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠে), নীল নীল রঙ আকাশে (মাসুদ করিমের কথা ও খন্দকার নূরুল আলমের সুরে খন্দকার ফারুক আহমেদ ও রওশন আরা মাসুদ, আমি চোখের জলে লিখেছিলাম লোকমান হোসেন কেিররকথা ও কাদের জামেরীর সুরে ইসমাত আরার কণ্ঠে) অনেক জীবনে আলোর লগ্ন (আজিজুর রহমানে কথা ও মোসলেহউদ্দীনের সুরে নাহিদ নিয়াজির কণ্ঠে), ওগো সোনার মেয়ে (কথা সুর ও মিল্পী মো মোসলেহ উদ্দীন) তারা এ দেশের সবুজ ধানের শীষে (ড. মো. মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাশের সুরে ইসমত আরা ও এম এ হামিদের কণ্ঠে), আমার দেশের মাটির গন্ধে (ড. মো. মনিরুজ্জামনের কথা ও আ. আহাদের সুরে সমবেত কণ্ঠে), পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা (আজিজুর রহমানের কথা ও মীর কাশিম খানের সুরে সমবেত কণ্ঠে), কিছু বলো কিছু বলো (ড, মো. মনিরুজ্জামানের কথা ও আব্দুল আহাদের সুরে সৈয়দ আ হাদীর কণ্ঠে), সব কিছু মোর উজাড় করে দিয়েছি তোমায় তুলে ( মাসুদ করিমের কথা ও রাজা হোসেন খানের সুরে সৈয়দ আ. হাদীর কণ্ঠে), তুমি সন্ধ্যাকাশে তারার মত আমার মনে জ¦লবে (মুসা আহমেদের কথা ও আজমল হুদা মিঠুর সুরে সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে), সোনার কাঠি রুপার কাঠি (নঈম গওহরের কথা ও আনোয়ার পারভেজের সুরে সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে) গানগুলো আমার কণ্ঠে বুলবুলির মত সুর খেলাতে থাকে। মনের ভেতর একটা স্বপ্ন লালন করতে থাকি আমি, একদিন আমি বড় শিল্পী হবো। ঠিক একজন লতা মঙ্গেশকর বা সাবিনা ইয়াসমিন হয়ে উঠবো! শুধু আমি জানতাম না, রেডিও শুনে গান মুখস্থ করলে বা একা একা গান গাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না! তার জন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়। আমার আগুন ছিল, তবে পোড়ানোর জন্য কাঠ বা খড় কিছুই ছিল না। (চলবে)
* সত্তর দশকে একজন রেডিওতে একজন সিনেমা আরজে ছিলেন। তাঁর নাম কি আজমল হুদা মিঠু ছিল? যিনি ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা অভিনেতা ও ডাবিং শিল্পী? সিনেমা বিজ্ঞাপনের ঐ আরজে সম্পর্কে কেউ কিছু জানলে দয়া করে জানাবেন বা লিংক দেবেন।
ঝর্না রহমান
পোস্ট: ২৩ জুন ২০২০
================ অধ্যাপক ঝর্না রহমান ==============
বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের কেওয়ার গ্রামে। ঝর্না রহমান একজন কথাসাহিত্যিক,কবি ও সংগীত শিল্পী। চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি লেখালিখির সাথে জড়িত।
গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধনিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। চারটি সম্পাদনা গ্রন্থসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার ভ্যাংক্যুভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য Trevor Carolan সম্পাদিত দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন The Lotus Singers গ্রন্থে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত পাঞ্জাবী সাহিত্যিক অজিত কৌর আয়োজিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে একাধিকবার সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।
পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা। অবসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র লেখালিখি। ঝর্না রহমান একাধারে একজন গীতিকার সুরকার এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী।
এ ছাড়া তিনি কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ পরণকথা এবং অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের মুখপত্র ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর সম্পাদনা করেন ।
তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই:গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা,নাগরিক পাখপাখালি ও অন্যান্য,পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী,নিমিখের গল্পগুলো,বিপ্রতীপ মানুষের গল্প,বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনূদিত গল্প) ,তপতীর লাল ব্লাউজ, উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা। কাব্য: নষ্ট জোছনা নষ্ট রৌদ্র, নীলের ভেতর থেকে লাল, জল ও গোলাপের ছোবল, জলজ পঙক্তিমালা, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়। কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি, নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী, প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: সেঁজুতি, রৌদ্রজলের গদ্য।
মা:রহিমা বেগম,বাবা:মোঃ মোফাজ্জল হোসেন,গ্রামের বাড়ি:কেওয়ার,মুন্সিগঞ্জ। জন্ম:২৮ জুন,১৯৫৯।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।