ঘূর্ণি (মুগদাপাড়া ও গনাইসার)
প্রকাশিত :রবিবার,২৮ জুন ২০২০ইং ।। ১৪ই আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।। বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক :
অধ্যাপক ঝর্না রহমান
১৯৭০ সনটা এদেশের রাজনৈতিক আর প্রাকৃতিক পরিবেশ দুদিকেই যেমন ঘূর্ণি তুলে জনজীবনে বিরাট একটা ধাক্কা লাগিয়েছিল, তেমনি সে সময়টায় আমার কিশোরী জীবনটাতেও অনেকগুলো ধাক্কা লেগেছিল। সবগুলো ধাক্কার কথা হয় তো এখানে লেখা যাবে না, তার জন্য লাগবে ভিন্ন প্রসঙ্গ ভিন্ন আলোকসম্পাত ভিন্ন চোখে দেখা আর ভিন্নভাবে অনুভব করা। এখানে আমি আমার গানের ভেলা বেয়ে যাচ্ছি। শৈশব থেকে নানা ঘাটে আমার ভেলা ভিড়ছে, এক এক ঘাটে এক একরকম সওদাপাতি হচ্ছে, সেসবই মূলত বলছি। নানাবাড়িতে ‘পল্লীবালা’র জীবন যাপনে দুআড়াই বছর আমার লেখাপড়াটা যে শিকেয় তোলা ছিল, সত্তরের শুরুতে এসে সেটা তো ছিঁড়লো, তারপর কী হল! তারপর আর কী, শিকে থেকে লেখাপড়ার নাড়ু–মোয়াভরা হাঁড়িটা নিয়ে আমি কেবল নগরগ্রামের হাটে হাটে ঘুরছি! আমার আব্বার অফিস তেজগাঁওয়ে। তিনি থাকেন নাখালপাড়ায় একটা মেসে, আম্মা আমার অন্য ভাইবোনদের নিয়ে থাকছেন বিক্রমপুরের গনাইসার গ্রামে। আর আমি ঢাকায় কখনো মামার বাসায়, কখনো মামাতো বোনের বাসায়! ছুটিছাটায় আবার চলে আসি গ্রামে। তবে ঢুকুশ ঢুকুশ করে আমার ক্লাস সেভেনের লেখাপড়াটা চলতে থাকে।
লক্ষ্মীবাজারের ফকির আব্দুল মান্নান স্কুলে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর (সেটা হাফ ইয়ারলি না মধ্যবর্তী কোনো টার্ম পরীক্ষা ছিল এখন আর তা মনে নেই।) সূত্রাপুরের মামাতো বোন শান্তি আপার বাসা থেকে আমি পাততাড়ি গুটিয়ে চললাম মুগদাপাড়া সেজো মামার নতুন বাসায়। মুগদা বাজারের কাছে টিটির বাড়ির কলোনিতে মামার নতুন বাসা। এখানে এসে আমি ভর্তি হলাম আমার শৈশবের স্কুল কমলাপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন শেরে বাংলা স্কুলে*। এটা তখন দুই শিফটের স্কুল। সকালে প্রাইমারি শাখা, পরের বেলা হাই সেকশন। অর্থাৎ আমি ভর্তি হলাম দিবা শাখায় সপ্তম শ্রেণীতে। এখানেও প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাই। তখনও মেয়েদের একা কিংবা দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসার ব্যাপারে অভিভাবকদের চিন্তিত হওয়ার মত পরিবেশ তৈরি হয়নি। বাসার কাছে স্কুল হলে সবাই বুকে বইখাতা চেপে পদব্রজে স্কুলে যাবে এটাই অনেকটা রীতি। আর আমাদের মত যারা বড়লোকের বিটি না, তাদের ‘হন্টন’ মাস্ট, এতো বলাই বাহুল্য! আমার স্কুল বাসা থেকে খুব কাছেও নয়। আধ ঘণ্টার মত লাগে। মুগদা পাড়া ছাড়িয়ে মেইন রোডে উঠলে কমলাপুরের রেললাইন এরিয়া শুরু হয়ে যেত। রেললাইনের ওপর দিয়ে বিশাল ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই স্কুল। রেললাইনের সেই ওভারব্রিজ আমার খুব আকর্ষণের জায়গা ছিল। সিঁড়িগুলো পার হয়ে ব্রিজের চাতালে দাঁড়ালেই মনে হত ঝপ করে আমি একটা অন্য শহরে চলে এলাম। চারপাশে ভিন্নরকম কোলাহল আর ব্যস্ততা। মাথার ওপরে বিরাট বড় ওলটানো আকাশ, সেখানেও আব আর রোদ্দুর মিলে হাটুরে ব্যস্ততা। আমি ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে সাপের মত আঁকাবাঁকা রেললাইনগুলো দেখি। ট্রেন এলে অনেক দূরে থাকতেই ব্রিজের ওপরে লোহালক্কড়ে একটা কাঁপুনি টের পাওয়া যায়। ওপর থেকে চলন্ত ট্রেন দেখতেও ভালো লাগে আমার। ভালো লাগে ট্রেনের ঝক্কর ঝক্কর শব্দ আর তীব্র হুইসেল! হুইসেল আমার মধ্যে একটা নেশা ধরাতো। আব্বার নাখাল পাড়া মেসেও যখন বেড়াতে গিয়েছি, দূর থেকে ছুটে আসা ট্রেনের হুইসেল শুনতে ভালো লাগতো। মনে হত রহস্যের দেশ থেকে ট্রেন ভরতি করে আসছে অনেক মানুষ। তাদের মধ্যে অনেক গল্প, অনেক আলাদা আলাদা জীবন! বড় হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ পড়ার পর মনে হয়েছে, শৈশবে আমিও ছিলাম একজন অপু!
এদিকে টিটির বাড়ি কলোনির বাসায় দু মাস যেতে না যেতেই মামা আবার বাসা পাল্টালেন। এবারের বাসা একেবারে মুগদাপাড়া গোরস্তান লাগোয়া। একটা দেয়ালই বাসা আর গোরস্তানের মধ্যবর্তী সীমানা। সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে ঘরে উঠতে নামতে দেয়ালের ওপারে চোখ পড়ে। গোটা গোরস্তানই একটা মরা মানুষের মত চুপ করে শুয়ে আছে যেন। শুনশান একটা মৃতপল্লীর ওপর দিয়ে সারাদিন সরসর শব্দ তুলে বাতাস চলে যায়। হঠাৎ কোনো পাখপাখালির ডাকও কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করে। সহজে ওদিকে তাকাতে চাই না। ভয় লাগে। সন্ধ্যা হলে মনে হয় বাতাসের ভেতর থেকে কাফনের মত হালকা সাদা কী যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। রাতের বেলা খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি নাকমুখ বুঁজে দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে কোনোমতে উঠোনের এককোণে আলাদা আর একটি ঘরে শুতে যেতাম। যদিও ঐ ঘরে মামাদের গৃহকর্মী সাবেদাও থাকতো তবুও ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো। বারবার আবাস বদল, স্কুল বদল, পরিবার বদল, পরিবেশ বদল আমার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল। এ ছাড়া, ফাইভ থেকে একটা ডাইভ দিয়ে আমি সেভেনে পড়া শুরু করেছি। সেভেনের লেখাপড়া বেশি। সিলেবাস কঠিন। সব কিছু সামাল দিতে গিয়ে আমি রীতিমত খাবি খেতে লাগলাম। আমার পাঁচ মামাতো ভাইবোনও সবাই ছোট ছোট। আমিই নিজেকে ওদের জন্য ‘হোম-টিউটর’ পোস্টে রিক্রুট করি। ওদের জন্য আমার অংক ইংরেজিটাও ঝালিয়ে নেয়া হতে থাকে। মামীও সারাদিন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। অবসরে তাঁকে সুচে সুতো ভরে দিলেও একটু সাহায্য হয়। তাই শিকা থেকে লেখাপড়াটা নামলো বটে, কিন্তু গানটাকে প্রায় শিকেয় তুলে রাখতে হল। এ ছাড়া শেরে বাংলা স্কুলে কোনো ‘আফরোজা’ নেই, এ বাসায় কোনো ইন্দ্রপুরীর ইমনরাগের গবাক্ষ নেই! আছে গোরস্তানের নির্জনতায় ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কতগুলো আমজাম আর নাম না-জানা গাছ। সারাদিন ওগুলোর আলোআঁধারিতে বসে অশরীরি আত্মারা কোরাস গায়!
আব্বা সময় পেলেই আসেন মুগদাপাড়া (তাঁকে তো আবার প্রতি সপ্তাহে গ্রামেও যেতে হয়। সেখানে আম্মাসহ সবাই আছেন। তখন আম্মা আবার অন্তঃসত্ত্বা) মামার বাসায় এসে আমাকে দেখে যান। দরকারী জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যান। তবে আব্বার পাশে বেশি ঘেঁসতে পারি না। মামা আর আব্বা তুমুল আলোচনায় বসে যান। আলোচনার বিষয় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এর মধ্যে আইউব আমল শেষ হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ইয়াহিয়া খান। দেশে চলছে সামরিক শাসন। আব্বার মুখে বারবার শুনি একটা শব্দ মার্শাল-ল! তারপর শুনি দেশ জুড়ে ভোট হবে। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রাম নতুন করে গতি লাভ করেছে। রেডিওতে তাঁর ভাষণ শুনতে পাই। দেশের নেতা তিনি। গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ছয়দফার মেনিফেস্টো নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। পার্লামেন্টের রূপরেখার ভালোমন্দ নিয়ে জনগণের মধ্যে তখন তুমুল আলোচনা চলছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও লেগেছে আন্দোলনের ধাক্কা! আব্বা যখন ঢাকা থেকে গনাইসার আসেন, তখন এ পাড়া ওপাড়া থেকে লোকজন এসে আমাদের উঠোনে ভিড় করে। আমাদের রেডিওটা তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সারা চোকদার বাড়িতে তখন এই ‘ট্রানজিস্টার’খানাই সবেধন নীলমনি! আব্বা এবং বড়দের কথাবার্তার একমাত্র বিষয়ই তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ছয় দফা, এগারো দফা, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, পিপিপি, পিপলস পার্টি, মওলানা ভাসানী, কৃষক শ্রমিক লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মোজাফফর আহমদ, ওয়ালী খান Ñ এরকম অজস্র শব্দ খইয়ের মত ফুটতো। রাজনৈতিক আলোচনায় আমার কোনো আগ্রহ না থাকলেও দেশের পরিস্থিতি যে বদলে যাচ্ছে এটা বুঝতাম। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন দেশে একটা কিছু ঘটাতে চলেছে এটাও মনে হচ্ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ টালমাটাল হয়ে উঠছিল। স্কুলে প্রায়ই ক্লাস হত না। স্যাররা ছুটি দিয়ে দিতেন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত হয় কি না সেটা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিল।
দেশের পরিস্থিতি আন্দোলনমুখর থাকলেও সে সময়টাতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছিল। আব্বাকে দেখলে আমার মনটা খুশিতে ডানা ঝাপটে ওঠে। আহ্লাদে গলে পড়তে চায়। আব্বা আমাকে বলেন, কীরে বাবা তোর কী লাগবে? আব্বাকে দেখলে যে আব্দারটা পাখির ঠোঁটে পাকা ফলের মত চলে আসে সেটা হল সিনেমা দেখার আবদার। ১৯৭০ সনে বেশ কয়েকটা সিনেমা বেরিয়েছিল। এর মধ্যে আছে ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘কত যে মিনতি’, ‘বিনিময়’, ‘কোথায় যেন দেখেছি’, ‘কাচ কাটা হীরে’, ‘কখগঘঙ’, ‘সন্তান’ ইত্যাদি। একএকটা সিনেমা রিলিজ হয় আর আমার মন ছোঁক ছোঁক করতে থাকে! কবে দেখবো! কারণ ঐ সময়ের সিনেমাগুলোতে অসাধারণ সুন্দর সুন্দর গান ছিল। গানগুলোর জন্যই সিনেমা দেখতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতাম। আব্বা নিজেও সিনেমা পছন্দ করতেন বলে বেশি ঝুলাঝুলি করতে হত না। সময় থাকলে নিয়ে যেতেন। সুতরাং সত্তরের টালমাটাল সময়ে আমার যাযাবর জীবনেও দেখা হল কয়েকটা সিনেমা। এর মধ্যে দুটি সিনেমা দেখলাম মামার বাসায় থাকা অবস্থাতেই। ‘সন্তান’ আর ‘মধুমিলন’। আব্বার সাথে ‘সন্তান’ সিনেমা দেখতে গেলাম মধুমিতা হলে। তখন রূপমহল বলাকা গুলিস্তান বিউটি মধুমিতা এই হলগুলোতেই বেশি সিনেমা দেখেছি। পরে আর একটা সিনেমা হল হয়েছিল অভিসার। সেদিন সেজ মামার মেয়ে ইয়াসমিনও থাকলো আমাদের সাথে। ইয়াসমিনের বয়স তখন সাত কি আট বছর। ‘সন্তান’ ছবিতে, যতদূর মনে পড়ে. দুই সন্তান নিয়ে রোজী সিদ্দিকীর কঠিন জীবন সংগ্রাম। সংগ্রামের পরতে পরতে দুঃখ যন্ত্রণা বঞ্চনা। একটা গানের মধ্য দিয়ে সেই দুঃখময় জীবনের লড়াইয়ের চিত্রমালা চলতে থাকে। গানটি হলো, আঞ্জুমান আরার গাওয়া খোকন সোনা বলি শোনো থাকবে না আর দুঃখ কোনো মানুষ যদি হতে পারো। রোজীর দুঃখে আমি ছবি দেখতে দেখতে সারাক্ষণ হাপুস নয়নে কাঁদি। ছোট্ট ইয়াসমিন আমার ফোঁপানি শুনে আমাকে আড়চোখে দেখে। কিন্তু দুঃখে কাঁদলে কী হবে, ঐ গান আমার কর্ণমূলে সুখ ঢেলে দিতে থাকে। প্যাথোজ গানের মেলোডি যে মর্মস্পর্শী হয় তা হয়তো ঐ বয়সে আমি বুঝিনি, কিন্তু সিনেমা দেখা শেষ করে চোখ মুছে আমি ঠোঁটে করে নিয়ে আসি সেই অসাধারণ দুঃখজয়ী গান। এ ছবির আর একটি গানও আমার প্রিয় গানের তালিকায় আজও সগৌরবে সুর ছড়ায়। কবরীর লিপে শাহনাজ রহমতুল্লাহর অসাধারণ হুইসপারিং ভয়েসে গাওয়া ‘যখন তখন বলে কেন মন’ (কথা: গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুর: সত্য সাহা)।
‘মধুমিলন’ সিনেমাও দেখলাম আব্বার সাথে মধুমিতা হলে। সে আমার জীবনের এক অমূল্য ধন মানিক রতন স্মৃতি। এ সিনেমায় নায়িকা শাবানার লিপে ফেরদৌসী বেগমের গাওয়া ‘কথা বল না বল ওগো বন্ধু’ (কথা: শহীদুল ইসলাম, সুর: বশীর আহম্মদ) গানটি আমাকে রীতিমত মাতাল করে ফেলে। গানের কথা, সুর, সুদর্শনা শাবানার সরল অকৃত্রিম সৌন্দর্য আর অভিনয় আমার মনের মধ্যে গানটিকে ‘বর্ণেগন্ধেছন্দেগীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা’ বানিয়ে দেয়। এ গানের ‘মন বলে গো’ জায়গায় এসে লম্বা সুরের খেলায় ফেরদৌসীর অসাধারণ কণ্ঠের ঝংকৃত ভায়াব্রেশন নিজের কণ্ঠে ফুটিয়ে তোলা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এক দমে ঐ জায়গাটি গেয়ে আবার সুর ধরে রাখার প্র্যাকটিস করে করে আমি ঐ গানে একেবারে ফেমাস হয়ে উঠি। গানের ব্যাকরণ না জানলেও তখনই কারিশমাটা টের পেয়েছিলাম। আমার গানের ভাণ্ডারে এ গান একটা সোনার প্রদীপের মত জ¦লতে লাগলো। সে সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরতো গানটি। আমাকে কেউ গান গাইতে বললেই এ গানটি গাই। কারণ এ গানের মধ্যে দম আর সুরের খেলা দেখানোর কারিশমা আছে। এর কিছুদিন পরে আমরা কোনো একটা উপলক্ষে আমার হারুন মামার বাসায় বেড়াতে গেলাম। সেবার আমার সেই গানপিয়াসী মামী (লুৎফুন্নাহার) আমাকে তাঁর পাশে শুইয়ে এই একই গান শুনতে শুনতে আধা রাত পার করে দিয়েছিলেন। ‘মধুমিলন’ চলচ্চিত্রের অন্য গানগুলোও ছিল অসাধারণ সুন্দর। কত আশা ছিল মনে, আঁধারের আলো হয়ে, শোন কথা শোনো ওগো প্রিয়তম – এ গানগুলো বশীর আহম্মদের ক্লাসিক ঢংয়ের মিষ্টি রোমান্টিক সুর আর অনন্যসাধারণ কণ্ঠমাধুর্য ও গায়কীর কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। সারা জীবনের জন্য এসব গান আমার প্রিয় গানের তালিকায় ঢুকে গেছে।
এর মধ্যে একদিন আব্বা গ্রাম থেকে আম্মা ও ছোট ভাইবোনদের ঢাকায় নিয়ে এলেন। উঠলেন মীরপুরে এফআইডিসি কলোনিতে আমার ছোট মামার (মাহফুজুর রহমানের বাসায়) বাসায়। আম্মার তখন অ্যাডভান্স স্টেজ। এদিকে আমার ছোট মামী তার দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার জন্য গ্রামে বাপের বাড়িতে গিয়েছেন। আর আমার আম্মা তাঁর সপ্তম সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য বাপের বাড়ি থেকে শহরে এসেছেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। আমি তখন সেজো মামা আর ছোট মামার বাসায় ‘সাফা-মারওয়া’ করি। এক মামার বাসায় আমার ভবিষ্যৎ আর এক মামার বাসায় আমার বর্তমান। যথাসময়ে আমার একটি ভাই হলো। এই ফুটফুটে চাঁদ-ভাইকে ছেড়ে আমার সেজ মামার বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সেখানে আমার ভবিষ্যৎ। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এমনিতেই লেখাপড়ার অবস্থা চানাচুর। কাজেই আমি চলে গেলাম মুগদাপাড়া, আম্মা ছেলেপুলে গুছিয়ে তুলে ফিরে গেলেন গনাইসার, আর আব্বা তাঁর চাকরিস্থলে।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ইলেকশন নিয়ে পরিবেশ উত্তাল হয়ে উঠলো। শহর জুড়ে মিছিল মিটিং প্রচার প্রচারণার ডামাডোল। পরিস্থিতি কোনদিকে যায় বলা যায় না। আব্বা আমাকে মামার বাসা থেকে বোঁচাকাবুঁচকিসহ গ্রামে নিয়ে এলেন। পরিস্থিতি বুঝে আবার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাবেন। আমারও গ্রামে আসার জন্য মন ছুটে গিয়েছিল। ছোট ভাইটাকেও আর দেখিনি। মনে মনে নামও ঠিক করে এনেছি আমি। আগের ভাইটার নাম তপন। ওর সাথে মিলিয়ে স্বপন। বাড়ি এসে ওর দুটো নাম পেলাম। রিপন আর সুমন। দুটোই বাতিল করে আমার নাম বহাল করলাম। আম্মা বিশেষ আপত্তি করলেন না। আমি বোধ হয় তখন সংসারে দু একটু সিদ্ধান্ত দেবার মত বড়ও হয়ে উঠেছি। কয়েকদিন পরেই তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
বাড়ি আসার কদিন পরেই এক তুমুল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল আশপাশের কয়েকটা গ্রাম। এমন ঝড় আমাদের ছোট্ট জীবনে কখনো দেখিনি। সেটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহা দুর্যোগময় দিন। সেই দিনের চেহারা ছিল ছোবল মারার আগে ফণা স্থির করে দাঁড়িয়ে থাকা সাপের মত থমথমে। দিনের বেলা কখনও এমন ঝপ করে অন্ধকারের ঘন কালো পর্দা নেমে আসতে পারে বুঝিনি। প্রচণ্ড গম্ভীর আকাশের মধ্যে লাল আগুনের মত মেঘও কখনও দেখিনি। আব্বাও তখন ঢাকায়। সেটা ছিল সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। তারিখ বারোই নভেম্বর। বিকেল হতেই তুমুল বৃষ্টির সাথে শোঁ শোঁ গর্জন করতে করতে এক একটা রাগী দৈত্যের মত ছুটে আসছিল বাতাস। আমরা ভেবেছি এটাই কেয়ামৎ। ইসরাফিলের শিঙ্গা বাজলেই এমন শব্দ হয়। তা নইলে বাতাসের এমন শব্দ হতে পারে না। প্রত্যেক ঘর থেকে লোকজন চিৎকার করে করে অন্য ঘরের লোকদের ডাকছিল। আমার মামা আর মামাতো ভাইরা আজান দিতে দিতে গলা ভেঙে ফেলছিলেন। ছোট ভাইবোনেরা আমাকে আর আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে থরথর করে কাঁপে আর চিৎকার করে কাঁদে। নানাদের ঘরটা অনেক পুরোনো। আমাদের মনে হচ্ছিল ঘরের চালাটাকে কাগজের ঠোঙার মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেই ভয়াবহ রাতে আম্মা আর আমি আমাদের ছোট ছোট একগাদা ভাই বোনকে পাখির ছানার মত বুকেপিঠে কোলে কাঁখে নিয়ে নানাদের ঘর ছেড়ে আজিজ মামাদের ঘরে গিয়ে উঠেছিলাম। সকালে উঠে দেখেছিলাম, আমরা এক লণ্ডভণ্ড বিধ্বস্ত জনপদের বাসিন্দা। সেবারই প্রথম জানলাম এ ঝড়ের নাম সাইক্লোন। সমুদ্র তীরে যত মানুষ বসবাস করতো সাইক্লোনের জলোচ্ছ¡াসে সবাই ভেসে গেছে। ১২ই নভেম্বরের সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ মানুষ ও ১০ লাখ গবাদিপশু মারা গিয়েছিল। আর ভয়ংকর সেই ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় এক রাতেই আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে আমাদের বাড়ির এবং আশেপাশের গ্রামেও অনেক ঘর উড়ে গিয়েছিল। বাইনখারা স্কুলের চালাটি দূরে একটা গাছের মাথায় গিয়ে আটকে ছিল। বড় বড় গাছের ডালপালা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গিয়েছিল, সমূলে উপড়ে গিয়েছিল অনেক গাছ। কিন্তু আমার ভেতরে সেই ভয়ঙ্কর ঝড় এক রাতেই কতগুলো বৃক্ষচারা গেঁথে দিয়েছিল। সেগুলো আমার ‘বড় হওয়া’ মনের দায়িত্ববোধের চারা। হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলাম আমি! (প্রথম কিস্তি শেষ। চলবে )
*খুব সম্ভবত শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়টি এখন কমলাপুর শেরে বাংলা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয় হয়েছে!
ঝর্না রহমান
পোস্ট ২৭ জুন ২০২০
================ অধ্যাপক ঝর্না রহমান ==============
বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের কেওয়ার গ্রামে। ঝর্না রহমান একজন কথাসাহিত্যিক,কবি ও সংগীত শিল্পী। চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি লেখালিখির সাথে জড়িত। গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধনিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। চারটি সম্পাদনা গ্রন্থসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার ভ্যাংক্যুভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য Trevor Carolan সম্পাদিত দক্ষিণ এশিয়ার গল্প সংকলন The Lotus Singers গ্রন্থে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত পাঞ্জাবী সাহিত্যিক অজিত কৌর আয়োজিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে একাধিকবার সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পড়াশোনার বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা। অবসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র লেখালিখি।
ঝর্না রহমান একাধারে একজন গীতিকার সুরকার এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী।
এ ছাড়া তিনি কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ পরণকথা এবং অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের মুখপত্র ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর সম্পাদনা করেন ।
তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই:-
গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা,নাগরিক পাখপাখালি ও অন্যান্য,পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী, নিমিখের গল্পগুলো, বিপ্রতীপ মানুষের গল্প, বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনূদিত গল্প) , তপতীর লাল ব্লাউজ, আয়নামমি।
উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা।
কাব্য: নষ্ট জোছনা নষ্ট রৌদ্র, নীলের ভেতর থেকে লাল, জল ও গোলাপের ছোবল, জলজ পঙক্তিমালা, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়।
কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি।
নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী।
প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: সেঁজুতি, রৌদ্রজলের গদ্য।
ভ্রমণ : আমরা যখন নেপালে।
ছড়া : ছড়াগাছে ছড়াফুল।
কবি ও কথাশিল্পী ঝর্না রহমান এর মা : রহিমা বেগম, বাবা : মোঃ মোফাজ্জল হোসেন, গ্রামের বাড়ি: কেওয়ার, মুন্সিগঞ্জ। জন্ম:২৮ জুন,১৯৫৯।
সংসার জীবনে কবি ও কথাশিল্পী ঝর্না রহমান একজন রত্নগর্ভা মা। তার তিন ছেলে, তিন ছেলেই ইঞ্জিনিয়ার এবং তিন পুত্রবধুও ইঞ্জিনিয়ার। পুত্রবধুদের তিনি মেয়ে বলে ডাকেন, এখন ৬ ইঞ্জিনিয়ারের গর্বিত মা। অধ্যাপক ঝর্না রহমান-এর স্বামী একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। জীবনের সফল এই মানুষটি যৌথ সংসারের হাল ধরে ঢাকার বসুন্ধরায় বসবাস করছেন। যখনই সুযোগ পান ছুটে যান বিক্রমপুরে-আপন ঠিকানায়।
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’
Login করুন : https://www.bikrampurkhobor.com
আমাদের পেইজ এ লাইক দিন শেয়ার করুন।