আজ বিক্রমপুরের কৃতীসন্তান সাঁতারু ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল জয়ের দিন

0
82
আজ বিক্রমপুরের কৃতীসন্তান সাঁতারু ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল জয়ের দিন

প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট ২০২০ইং ।। ৩রা ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ ।।

বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : আজ ১৮ আগস্ট, আজ বিশ্ব ক্রীড়াজগতে বাঙালির সাফল্যের স্বীকৃতি উজ্জ্বল একটি দিন। প্রথম বাঙালি এবং দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে প্রথম  সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া  সর্বপ্রথম ব্যক্তিও তিনি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বীর সন্তান’ হিসেবে সারাদেশ আজও গর্ববোধ করে তার জন্য। ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট বিপদসংকুল ইংলিশ চ্যানেল জয় করে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গণে বাঙালির সাফল্যের প্রথম স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। এই দেশেকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে যে ক’জন মানুষের অবদান রয়েছে, ব্রজেন দাস তাদের অন্যতম। এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি প্রথম সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। 

জন্ম ও পরিবার:

ব্রজেন দাসের জন্ম মুন্সীগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক বিক্রমপুর এলাকার কুচিয়ামোড়া গ্রামে  ১৯২৭ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হরেন্দ্র কুমার দাস। ব্রজেন দাস এর স্ত্রীর নাম মধু চন্দ্রা। তাদের সংসারে তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে।

 শিক্ষাজীবন:

বিক্রমপুর এলাকার কুচিয়ামোড়া গ্রামে  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ব্রজেন ঢাকার কেএল জুবিলি হাইস্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে ঢাকার কে.এল. জুবিলি হাই স্কুল থেকেএসএসসি পাস করেন। এরপর চলে যান কলকাতায়। পরে তিনি কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন।

 সাঁতার ক্যারিয়ার:

বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক ছিল। ফুটবল খেলা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন এবং স্কুলজীবনে সর্বদা স্কুল-ক্যাপ্টেন থেকেছেন। এরপর ভালো লাগতো ক্রিকেট। কিন্তু ছোটবেলায় সাঁতার কখনই তার কাছে খেলা মনে হয়নি। সাঁতার ছিল মজার বা আমোদের ব্যাপার। বুড়িগঙ্গা ছিল কাছেই। সাঁতারের আনন্দ ছিল একান্ত স্বাভাবিক। আন্তঃবিদ্যালয় খেলাধুলায় সাঁতার প্রতিযোগিতায় সর্বদাই প্রথম স্থান দখল করতেন। কলকাতায় কলেজ জীবনে সাঁতারের দিকে বিশেষ কারণে আগ্রহ জন্মায়, কারণ তার বাড়ির কাছাকাছি ফুটবল-ক্রিকেটাদি খেলার মাঠ ছিল না, অথচ সুইমিংপুল ছিল। সন্তরণক্রীড়ার বিজ্ঞান অর্থাৎ সাঁতারের বিভিন্ন কায়দা, নিয়মকানুন ইত্যাদি তিনি সেখানেই শেখেন। কলকাতায় ছাত্রাবস্থাতেই তিনি সাঁতারে প্রথম হতেন।

১৯৪৮-৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আন্তকলেজ প্রতিযোগিতায় প্রথম বড় ধরনের জয়ের আস্বাদ পান। এরপর ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর ভারত থেকে নিজের দেশের মাটিতে ফিরে আসেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে বাৎসরিক সাঁতার প্রতিযোগিতার কার্যক্রম শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০, ২০০, ৪০০, ও ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি পর পর ৪ বছর চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় সর্বমোট চারটি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মেলবার্নের অলিম্পিকে পাকিস্তান দল থেকে তাঁকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানি সাঁতারুদের নেওয়া হয়েছিল। চরম হাতশা কাটিয়ে এরপর ইনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দীর্ঘপথ সাঁতারের অনুশীলন করা শুরু করেন।১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত সাঁতারে যান।

ইংলিশ চ্যানেল ও ব্রজেন দাসঃ  

ইংরেজি ভাষায়: English Channel, ফরাসি ভাষায়: La Manche লা মঁশ্‌ ।   পশ্চিম ইউরোপের একটি সংকীর্ণ সাগর যা ফ্রান্স এবং গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপকে পৃথক করেছে এবং উত্তর সাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ফরাসি ভাষায় এটি লা মঁশ (La Manche অর্থাৎ “কোটের হাতা”) নামে পরিচিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬২ কিলোমিটার এবং এর প্রস্থ অবস্থানভেদে সর্বোচ্চ ২৪০ কিলোমিটার থেকে সর্বনিম্ন ৩৪ কিলোমিটার (ডোভারের প্রণালীতে) হতে পারে। পূর্বদিকে এর বিস্তার কমে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার হয়ে যায় এবং সেখানে এটি ডোভার প্রণালীর মাধ্যমে উত্তর সাগরের সাথে সংযুক্ত। ইংলিশ চ্যানেলের প্রধান দ্বীপগুলির মধ্যে আছে আইল অভ ওয়াইট এবং চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জ। প্রধান বন্দরগুলির মধ্যে আছে ফ্রান্সের শেরবুর্গ ও ল্য আভ্র্‌, এবং গ্রেট ব্রিটেনের সাদাম্পটন। ছোট বন্দরগুলির মধ্যে আছে গ্রেট ব্রিটেনের ডোভার, প্লিমাথ ও পোর্ট্‌স্‌মাথ এবং ফ্রান্সের কালে, দাঁকের্ক, বুলোঞ-সুর-মের ও দিয়েপ। এই সব বন্দরগুলির মধ্যেই নিয়মিত ফেরি সংযোগ আছে। রেল ফেরিগুলি কোন বিরতি ছাড়াই লন্ডন ও প্যারিসের মধ্যে যাত্রী পরিবহন করে। ডোভার ও কালে শহরের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের উপর দিয়ে আধা ঘণ্টার হোভারক্রাফট পরিবহনের ব্যবস্থা আছে। ১৮০২ সালে ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে সুরঙ্গ খুঁড়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝিতে এসে এটির খননকাজ শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে কাজটি সমাপ্ত হয় এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে যাত্রী, গাড়ি ও ট্রাক পরিবহন সম্ভব।

  ইংলিশ চ্যানেলে মাছ ধরা কমে গেছে। এখন শুধুমাত্র উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের কাছাকাছি মাছ ধরা হয়। এছাড়াও সেখানে রঁস নদীর মোহনায় চ্যানেলের শক্তিশালী জোয়ার কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ইংলিশ চ্যানেলের তীরে, ফ্রান্স ও ব্রিটেন উভয় দেশেই অনেক সমুদ্রতীরবর্তী অবকাশকেন্দ্র আছে।বিশাল এই ইংলিশ চ্যানেল প্রথম পাড়ি দেন একজন সাহসী বীর, তার নাম ব্রজেন দাস। তিনি একজন বাংলাদেশি সাঁতারু। তিনিই প্রথম দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তি যিনি সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন।

১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।ব্রজেন দাস সর্বমোট ছ‘বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন: ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১ সালে। দিনটি ছিল ১৮ই আগস্ট ১৯৫৮। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের এই প্রতিযোগিতায় মোট ২৩টি দেশ অংশগ্রহণ করেন। এই প্রতিযোগিতায় ব্রজেন দাস পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেদিন মধ্যরাতে ফ্রান্সের তীর থেকে প্রতিযোগিতার শুরু হয়। সে সময় পরিবেশ ছিল প্রতিকূলে। এই সময় ইংলিশ প্রণালী ছিল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ এবং পানির উপরিভাগ ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। শত বাধা পেরিয়ে তার পরের দিন বিকেলে প্রথম সাতারু হিসেবে ব্রজেন দাস ইংল্যান্ড তীরে পৌছান। ১৯৬১ সালে ১০ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ে তিনি বিশ্বরেকর্ড গড়েন। ব্রজেন দাস সর্বমোট ছয় বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। এর মধ্যে একবার তিনি কোনোরকম বিরতি না দিয়েই ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-ইংল্যান্ড সাঁতার কেটে পাড়ি দেন।১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ফ্রিস্টাইল সাঁতারে তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পর পর ৪ বছর চ্যাম্পিয়ন হন। এছাড়া তিনি ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের জাতীয় প্রতিযোগিতায় ফ্রিস্টাইল সাঁতারের শিরোপা জেতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি অলিম্পিক গেমসে পাকিস্তান সাঁতার দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্রজেন দাস ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে ইতালির কাপ্রি দ্বীপ হতে নাপোলি পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দূর পাল্লার সাঁতারে ৩য় স্থান অর্জন করেন। একই বছর আগস্ট মাসে তিনি ইংল্যান্ডে বিলি বাটলিনের চ্যানেল ক্রসিং প্রতিযোগিতায় ২৩টি দেশের ৩৯ জন সাঁতারুকে হারিয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। সেপ্টেম্বরে তিনি ইংলিশ চ্যানেলকে ইংল্যান্ড হতে ফ্রান্সে সাঁতার কেটে পার হন। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালের আগস্টে তিনি ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড সাঁতার কাটেন। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল সবচেয়ে কম সময়ে পাড়ি দেন।

আন্তর্জাতিক দীর্ঘপথ সাঁতারে অংশগ্রহণ এবং কৃতিত্বের তালিকাঃ

ইতালি

 জুলাই ১৯৫৮  কাপ্রি দ্বীপ থেকে নাপোলি পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দূর পাল্লার সাঁতার। তৃতীয় স্থান

ইংল্যান্ড

 আগষ্ট ১৯৫৮  ২৩টি দেশের ৩৯ জন সাঁতারুর মধ্যে প্রথম। ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স। ইংলিশ প্রণালী।

ইতালি

 জুলাই ১৯৫৯  কাপ্রি দ্বীপ থেকে নাপোলি পর্যন্ত (ভূমধ্যসাগরে)

ইংল্যান্ড

 আগষ্ট ১৯৫৯  ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড। ইংলিশ প্রণালী।

ইংল্যান্ড

 সেপ্টেম্বর ১৯৫৯        ইংল্যান্ড  থেকে ফ্রান্স। ইংলিশ প্রণালী।

ইংল্যান্ড

 আগষ্ট ১৯৬০  ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড। ইংলিশ প্রণালী।

ইংল্যান্ড

 সেপ্টেম্বর ১৯৬১        ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড। ইংলিশ প্রণালী।

ইংল্যান্ড

 সেপ্টেম্বর ১৯৬১        ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড। ইংলিশ প্রণালী। বিশ্বরেকর্ড স্থাপন।

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সাঁতারের সঙ্গে এই অঞ্চলের আপামর মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। সাঁতার বাঙালিদের নিজস্ব খেলা। অথচ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সাঁতার ফেডারেশনের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে, যেখানে নদী নেই। জাতীয় ফেডারেশনের প্রথম নির্বাহী কমিটিতে কোনো বাঙালির স্থান হয়নি! পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার ও সমতাকে প্রথম থেকেই অস্বীকার করা হয়েছে। পশ্চিমারা প্রথম থেকেই ক্রীড়াঙ্গনে বৈষম্যের রাজনীতি টেনে এনেছে। নোংরা রাজনীতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাঁতারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চত্বর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে।

১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল অলিম্পিক। এই অলিম্পিকে সাঁতারে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে প্রথম হন সাঁতারু ব্রজেন দাস। তাঁর জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরের সিরাজদিখান থানার কুচিয়ামারা গ্রামে। বাঙালি যুবক ফ্রি-স্টাইল সাঁতারে প্রথম—এটা পশ্চিম পাকিস্তানের সাঁতারের বিচারকরা মেনে নিতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাঁতারুকে পেছনে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সাঁতারু প্রথম—এটা হতে পারে না। অতএব বিচারকরা মনগড়া কারণ দেখিয়ে ব্রজেন দাসকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিয়ে তখন হৈচৈ হয়। পরের দিন ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় এই রায়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি হওয়ায় এই ইভেন্টের আবার আয়োজন করা হয়। এবারও ব্রজেন দাস প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক নিশ্চিত করেন। ১৯৫৫ সালের পাকিস্তান অলিম্পিকেও ব্রজেন দাস ১০০ ও ৪০০ মিটার ইভেন্টে প্রথম হন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রজেন দাস আশা করেছিলেন ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে পাকিস্তান দলে তাঁকে নেওয়া হবে—এর জন্য তিনি কঠোর অনুশীলনও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রজেন দাসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি অলিম্পিক দলে। যাঁরা তাঁর সঙ্গে ন্যাশনাল অলিম্পিকে পেরে ওঠেননি—তাঁদের দলে স্থান দেওয়া হয়েছে।

দুঃখ পেয়েছেন কিন্তু ভেঙে পড়েননি ব্রজেন দাস। দৃঢ় মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাসী মানুষটি ঠিক করলেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সাঁতার অঙ্গনে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সাঁতারে বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবেন। তখন ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতারের ছিল বিশ্ব ক্রীড়াচত্বরে আলাদা মর্যাদা, আবেদন ও জৌলুস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা দূরপাল্লার সাঁতারুরা এই সাঁতারে অংশ নিতেন। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া একটি বিশেষ একক কৃতিত্বের ব্যাপার ছিল তখন আন্তর্জাতিক সাঁতার অঙ্গনে। ব্রজেন দাস সাহায্য ও সহযোগিতা চাইলেন ক্রীড়ানুরাগী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে। সবাই বুঝলেন ব্রজেন সফল হলে এটি হবে ক্রীড়াঙ্গনে বাঙালি ক্রীড়াবিদের বিশাল অর্জন। অবহেলা, বঞ্চনার বিপক্ষে সমুচিত জবাব। গঠিত হলো চ্যানেল ক্রসিং কমিটি (সিসিসি)। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে ক্রীড়া সংগঠক ব্যক্তিত্বদ্বয় প্রকৌশলী মাইনুল ইসলাম ও এস এ মহসিন। কমিটিতে আরো যাঁরা ছিলেন—সাংবাদিক এ বি এম মূসা, ক্রীড়া সাংবাদিক ও সংগঠক এস এ মান্নান (নাডু), সংগঠক মো. শাহজাহান, নূর হোসেন, মোল্লা আবদুল মজিদ, কাজী শামসুল ইসলাম, এফ এ করিম প্রমুখ। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানকে সিসিসির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়।

কমিটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো ব্রজেন দাসকে পাঠানো হবে ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতারে অংশ নিতে। প্রস্তুতি পর্বের জন্য একটি পরিকল্পনার ছক ঠিক করা হলো চ্যানেলের কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং অনুশীলনের জন্য বেশ কিছুদিন আগেই ব্রজেনের যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজন বড় অঙ্কের অর্থের। সরকার, জাতীয় সাঁতার ফেডারেশন এমনকি ইপিএমএফও কোনো রকম সাহায্য করবে না। অর্থ সংগ্রহের প্রধান ভার পড়ল সভাপতির ওপর। তিনি বিভিন্নভাবে চাঁদা তুলে ‘ফান্ড’ জোগাড় করেন। ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা রুটে পিআইএ সৌজন্য টিকিট দিতে রাজি হয়নি।

এস এ মহসিনকে ম্যানেজার আর প্রশিক্ষক মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে ব্রজেন ঢাকা ছাড়লেন লন্ডনের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছেই শুরু করলেন আবার অনুশীলন, সাঁতার কেটেছেন চ্যানেলে। অংশ নিয়েছেন—ক্যাপ্রি দীপ থেকে নেপলস পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারে। ভালো প্রস্তুতি ব্রজেন দাসের আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিল।

এরপর এলো সেই স্মরণীয় দিন ১৮ আগস্ট ১৯৫৮ সাল। ২৩টি দেশের ৩৯ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে ঝাঁপ দিলেন পানিতে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল কৃতিত্বের সঙ্গে অতিক্রম করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। ১৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিটে দূরত্ব অতিক্রম করে প্রথম হলেন পাকিস্তানের ব্রজেন দাস। আন্তর্জাতিক সাঁতার অঙ্গনে এটিই কোনো পাকিস্তানির প্রথম একক সাফল্য। শুধু তা-ই নয়, ব্রজেন প্রথম এশিয়ান, যিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে প্রথম হয়েছেন। ব্রজেন পাকিস্তানের পতাকাকে আন্তর্জাতিক চত্বরে তুলে ধরেছেন গৌরবের সঙ্গে। পরিচিত করেছেন পাকিস্তানকে। অথচ এই ব্রজেন দাসকে বারবার অবহেলা করা হয়েছে। তাঁকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। যে পাকিস্তানিরা বাঙালি সাঁতারুকে একসময় অবহেলা করেছে—তাঁকেই তারা পরে জাতীয় ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। প্রায় ছয় দশক আগে ব্রজেন দাসের সাহায্যে পুরো পাকিস্তানে আনন্দ-উৎসব হয়েছে।

মনে আছে, পূর্ব পাকিস্তানে অনেক স্কুল ও কলেজ এক দিন ছুটি দেওয়া হয়েছিল। অভিনন্দনের টেলিগ্রামে ব্রজেন দাসের কাঁধের ব্যাগ ভরে গেছে, এ কথা ১৯৭২ সালে আমার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন। পাকিস্তানে ফিরে আসার পর করাচির কমিশনার এন এম খান ব্রজেন দাসের জন্য বীরোচিত সংবর্ধনার আয়োজন করেন। আইয়ুব খান তাঁকে বুকে ছড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘ব্রজেন, তুমি পাকিস্তানের গর্ব। তুমি দেশকে একক প্রচেষ্টায় যেভাবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াচত্বরে তুলে ধরেছ, তা আর কেউ পারেনি। তুমি এখন পাকিস্তানের সাঁতারে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

১৯৬১ সালে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টির পর ইংল্যান্ডে পাকিস্তান হাইকমিশনে ব্রজেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনায় ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট বেটেন উপস্থিত ছিলেন। ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁকে কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে আসার পর ঢাকা স্টেডিয়ামে ব্রজেন দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান ব্রজেন দাসকে অভিনন্দন জানিয়ে ‘বাঙাল কা শের’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপর ইংল্যান্ডের রানি ও তাঁর মা পাকিস্তান সফরে এলে করাচিতে নাগরিক সংবর্ধনায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র ক্রীড়াবিদ ব্রজেন দাসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রানি ব্রজেন দাসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। রানির সঙ্গে ব্রজেন দাসের সেই ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কালের চক্র বাঙালি সাঁতারুর সেই অসাধারণ সোনালি অধ্যায়ের ওপর এখন ধুলো জন্মিয়েছে!

 পুরস্কার ও সম্মাননা:

 বিভিন্ন সাতার প্রতিযোগিতার পুরস্কার স্বরূপ অসংখ্য পুরস্কাররের অধিকারী ব্রজেন দাস। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন।

 ১৯৫৯: প্রাইড অফ পারফরমেন্স, পাকিস্তান সরকার

 ১৯৭৬: জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার, বাংলাদেশ (মরণোত্তর)

 ১৯৮৬ : “KING OF CHANNEL। Channel Swimming Association of the United Kingdom

 ১৯৯৯: স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, বাংলাদেশ (মরণোত্তর)

 জীবনাবসান:

প্রশিক্ষণের পেশা গ্রহণের জন্য বিদেশ থেকে বহু আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও তিনি অর্থ কিংবা খ্যাতির মোহে স্বদেশ ছেড়ে যাননি। আজ আমরা ভূলে গেছি ব্রজেন দাসকে। তিনি বাঙালি হিন্দু, বাংলাদেশ তথা এশিয়ার গর্ব  ১৯৯৭ সালে ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। এজন্য বেশ কিছুদিন ব্রজেন দাস কলকাতায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯৯৮ সালের ১ জুন ৭০ বছর বয়সে ব্রজেন দাস কলকাতায় মারা যান।

তথ্যসূত্র :

*  ব্রজেন দাসের উপর নির্মিত ওয়েব সাইট: www.brojendas.com

* শিশু বিশ্বকোষ

*বাংলাপিডিয়াতে ব্রজেন দাসের জীবনী।

* ব্লগ

নিউজটি শেয়ার করুন .. ..

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন