প্রকাশিত: সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ইং।। ১লা ফাল্গুন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)।। ১১ রজব,১৪৪৩ হিজরি।।
বিক্রমপুর খবর : অনলাইন ডেস্ক : আজ সোমবার পহেলা ফাল্গুন-ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। রাজধানীসহ সারাদেশে নানা আয়োজনে চলছে বসন্ত বরণ। বিপুল ঐশ্বর্যের ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। প্রকৃতি সাজবে তার নতুর রূপে। গাছে গাছে ফুল ফুটুক আর নাই-বা ফুটুক, বসন্ত তার নিজ রূপ মেলে ধরবেই। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে বাঙালি তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হবে।গাছে গাছে ফিরে এসেছে চিরায়ত প্রাণের দ্যোতনাভরা সবুজ। নবরূপে জেগেছে পত্র, পুষ্প, পল্লব।
এবারের বসন্ত এসেছে এমন সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছে করোনার ভয়াল প্রভাব। এরপরও বাংলাদেশে বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে অনেক। শীত চলে যায় রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা।
শীতের রিক্ততা মুছে প্রকৃতিজুড়ে সাজ সাজ রব এখন। বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠেছে নতুন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশের সোনাঝরা আলোর মতোই আন্দোলিত হৃদয়। আপ্লুত। আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘আহা, আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে/কত পাখি গায়।’ বছর ঘুরে আবার এলো সেই ফুল ফোটার দিন।
‘দখিন সমীরণের শিহরণ’ জাগানোর মাহেন্দ্র দিন এলো। মাতাল হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাসে, পল্লব মর্মরে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে : ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে..।
বনের মতো মনেও অদ্ভুত এক শিহরণ জাগানিয়া দিন এখন। রূপ লাবণ্যে জেগে উঠেছে প্রকৃতি, রঙিন চারপাশ। বৃক্ষের নবীন পাতায় আলোর নাচন! গোলাপ, জবা, পারুল, পলাশ, পারিজাতের হাসি। সেই প্রাচীন প্রাকৃত পেঙ্গলের দিকে তাকালে আমরা দেখবো বসন্তরাজের করতলে ভালোবাসার নৈবেদ্য তুলে দিতে কেমন ব্যস্ত কবিরা। বসন্তের বন্দনা করে একটি পংক্তিও লেখেননি, এমন বাঙালি কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আজকের পূর্ব আকাশের নবীন ঊষা, প্রভাতের নবীন ঊষা বাংলার প্রকৃতিতে নিয়ে এসেছে ঋতুরাজের দোলা। খুলে গেছে দখিনা দুয়ার। মানব-মানবীর হৃদয়ের বেদি আর প্রজাপতির রঙিন পাখা, মৌমাছির গুনগুনানি, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে, শাখায় শাখায়, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর অরণ্য-পর্বতে নবযৌবনের বান ডেকেছে। প্রকৃতির এই রূপতরঙ্গে দুলে উঠে কবিগুরু গেয়ে ওঠেন- ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’ শীতের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়া, বিবর্ণ জারুল-পারুল, মাধবী-মালতী-রজনীগন্ধা, পলাশ-জবা, কৃষ্ণচূড়া-দোপাটি, কনকচাঁপার গুচ্ছ আন্দোলিত হচ্ছে দখিনা বাতাসে নবজীবনের স্পন্দনে। আড়মোড়া ভেঙে বাতাসে হিল্লোর তুলছে আম-কাঁঠালের বাগান। বসন্ত-বন্দনা করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ‘হয়তো ফোটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যতো আছে/হয়তো গাহেনি পাখি, অন্তর উদাস করা সুরে/…তবুও ফুটেছে জবা, দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।’
গণমানুষের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন- ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক/আজ বসন্ত।’ শীতের রিক্ততা মুছে দিয়ে প্রকৃতিজুড়ে আজ সাজসাজ রব। হিমেল পরশে বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠছে নবীন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশ সোনাঝরা আলোর মতই হৃদয় আন্দোলিত। আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে…। ‘আহা, আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে/ কত পাখি গায়..।’ নব পুষ্পপত্র-পল্লবে, প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে উঠেছে।
বসন্তকে বলা হয় প্রেমের ঋতু। মাতাল করা নানা ফুলের সৌরভে মানব হৃদয়ে পূর্ণতা পায় প্রেমের অনুভূতি। বসন্ত যেন সব বাধা ভেঙে দিয়ে প্রিয়তমার হাত ধরে বলতে চায়- ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমাকে অশোকে-কিংশুকে/অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণে সুখ…।’ কিংবা শচীন-কর্তার মতো করে গেয়ে উঠবে- ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/প্রেমে পড়েছি আমি।’ অথবা প্রেমের দেবতা কিউপিটের ছোড়া তীরে বিদ্ধ প্রেমিক জুটি সূর্যের মুখে তাকিয়ে বলবে- ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব/তুমি আছো, আমি আছি।’
শুধু প্রাণের দুরন্ত আবেগ আর প্রেমে নয়, এ ঋতুতে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে দ্রোহে-প্রতিবাদে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো বার্তা ছড়ায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন…।’ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে বাংলার তরুণরা রক্ত ঝরিয়েছে এ ঋতুতে। আবার সামরিক-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও রক্ত ঝরিয়েছে এই বসন্তে। তাই দোসরা ফাল্কগ্দুন ‘সামরিক-স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্র দিবস’!
সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই পেয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমায় নানাভাবে। হালে শহরের যান্ত্রিকার আবেগহীন সময়ে বসন্ত যেন কেবল বৃক্ষেরই, মানুষের আবেগে নাড়া দেয় কমই। কবির ভাষায়-মানুষের হৃদয় আজ আনন্দে ভরে উঠুক/দুঃখগুলি সব ঝরে যাক/মানুষের মন হোক অনন্ত,/আজ যে বসন্ত..।
বছর ঘুরে আবারও ফাগুন এলো। ষড়ঋতুর বাংলায় বসন্তের রাজত্ব একেবারে প্রকৃত সিদ্ধ। ঋতুরাজ বসন্তের বর্ণনা কোনো রঙতুলির আঁচড়ে শেষ হয় না। কোনো কবি-সাহিত্যিক বসন্তের রূপের বর্ণনায় নিজেকে তৃপ্ত করতে পারেন না। তবুও বসন্ত বন্দনায় প্রকৃতি-প্রেমীদের চেষ্টার যেন অন্ত থাকে না।
বসন্তের সমীরণ বলছে এ ঋতু সব সময়ই বাঙালির মিলনের বার্তা বহন করে। কারণ বসন্তেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। বসন্তেই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল।
ফাইল ফটোঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের বর্ণিল পরিবেশনা।
বসন্তেই বাঙালি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করেছিলেন। আবার এ বসন্তেই তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়। আর শহরের নাগরিক জীবনে বসন্তের আগমণবার্তা নিয়ে আসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’ ও একুশের বইমেলা।
‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান–
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান–
আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ॥’
প্রকৃতি প্রেমে সিদ্ধকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফাগুনবন্দনা করে লেখা বিখ্যাত গান। আজ ফাগুনের উদাস হাওয়ায় বাঁধন ছিঁড়েছে প্রাণ। বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ তাই উড়ু উড়ু। ফাগুনের অগ্নিধারায় আপনকেও হারালো মন। হারানো মন ঘুরছে ফাগুন রাঙা যেন বনে বনে।
বাঙালির ইতিহাস আবেগের। এ আবেগ যেমন মানুষে মানুষে ভালোবাসার, তেমনি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিরও বটে। দিন-ক্ষণ গুণে গুণে বসন্ত বরণের অপেক্ষায় থাকে বাঙালি। কালের পরিক্রমায় বসন্ত বরণ আজ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। আবাল-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী বসন্ত উম্মাদায় আজকে মেতে উঠবে।
বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলায় মেলা, সার্কাসসহ বাঙালির নানা আয়োজনের সমারোহ থাকবে। ভালোবাসার মানুষেরা মন রাঙাবে বাসন্তী রঙ্গেই। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও।
বসন্তের প্রকৃত রূপ দেখা যায় গ্রামে; শহরে তেমন নয়। ষড়ঋতুর দেশে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিতেই মূলত বসন্ত জানান দেয় তার আগমনী বারতা। গ্রামের মেঠো পথ, নদীর পাড়, বৃক্ষরাজি, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তে রঙিন হয়ে ওঠে। নিসর্গের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে বাঙ্ময়। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই তখন বাঙালির মনে দোলা লাগে, হৃদয় উচাটন হয়।
তরুণীরা বাসন্তী রঙয়ের শাড়ি পরে প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দিতে চাইবে। আর বসন্তের উদাস হাওয়ায় তরুণেরা নিজেকে প্রকাশ করবে প্রেমে প্রেমে। বসন্ত যেন মানবমন আর প্রকৃতির রূপ প্রকাশের লীলা-খেলা।
বসন্ত উৎসব আজ গ্রামীণ আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। শহুরে মানুষের কাছেও বসন্তের আবেদন ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে শহরের তরুণ-তরুণীরা বসন্ত বরণে দিনভর ব্যস্ত থাকে। ফুলে ফুলে ভরে যাবে তরুণীর চুলের খোপা। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বসবে খাবারের মেলা।
এদিন দর্শনীয় স্থানগুলো মানুষের পদচারণায় যেন তিল ধরার ঠাঁই থাকে না। বসন্তের আগমনে নব উদ্যমে জেগে উঠুক বাঙালি, জেগে উঠুক বাঙালির প্রাণ।
বসন্তের সাজে আজ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হবে। প্রীতির বন্ধনে আপন মহিমায় খুঁজে নেবে বসন্তকে। সেই মিলনের তাগিদে আজ সারা দিন দেশের নানা প্রান্তে বসন্তবরণে মেতে উঠবে জাতি।
বসন্তের প্রথম দিনে আজ নানা আয়োজনে আলোড়িত হবে রাজধানী ঢাকা। তরুণ-তরুণীরা বইমেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলার বকুলতলা মাতিয়ে রাখবে সারা দিন। নগরীর বিভিন্ন উদ্যান, খাবারের দোকানগুলো মুখর থাকবে।
ফুলের মঞ্জরিতে মালা গাঁথার দিন বসন্ত কেবল প্রকৃতিকেই রঙিন করেনি, রঙিন করেছে আবহমান কাল ধরে বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রাণ। তাই আজ পহেলা ফাল্কগ্দুনের এ দোলা জাগানো দিনে তরুণীরা খোঁপায় গাঁদা-পলাশ ফুলের মালা গুঁজে বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে, তরুণরা পাঞ্জাবি-পাজামা কিংবা ফতুয়ায় খুঁজে নেয় শাশ্বত বাঙালিয়ানা। আজ তাই উৎসবের হাওয়ায় তরুণ-তরুণীদের ভাসতে দেখা যাচ্ছে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, টিএসসি আর অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ নগরের নানা স্থানে। এমনকি দূর মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে তারুণ্যের এই যাত্রা। ফোনে, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চলছে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়।
বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এ উৎসব আয়োজন করে আসছে।স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎসব আয়োজনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। প্রতিবছরের মতো এবারো জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে বসন্ত উৎসব আয়োজন করা হবে। এ ছাড়াও দেশের নানা জায়গায় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নাচ, গান, আবৃত্তিসহ নানা আয়োজনে পহেলা ফাগুন ও ভ্যালেনটাইনস ডে উদযাপন করবে। তবে করোনা মহামারির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সব আয়োজন থাকবে স্বল্প পরিসরে। এ সব উৎসবে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতিতে নগরীর বিভিন্ন উদ্যান, পার্ক, খাবারের দোকান মুখর হয়ে উঠবে।
(বিজ্ঞাপন) https://www.facebook.com/3square1
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’