প্রকাশিত:রবিবার,২১এপ্রিল২০১৯:৮ই বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।
বিক্রমপুর খবর:নিজস্ব ডেস্ক: আজ সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সাথে নেমে আসবে অতি পুণ্যময় রাত। দিনের আলো পশ্চিমে মিলিয়ে যাবার পরই শুরু হবে কাঙ্ক্ষিত এই রজনী, পবিত্র শবে বরাত। পাপ থেকে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে নিষ্কৃতি লাভের অপার সৌভাগ্যের রাত আজ। শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে পবিত্র শবে বরাত পালিত হয়।
বিশ্বের অন্যান্য আরো কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ যথাযথ মর্যাদায় ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র শবে বরাত উদযাপিত হবে। এ উপলক্ষে প্রতিটি মসজিদে নফল নামাজ, ওয়াজ মাহফিল, জিকির-আসকারের আয়োজন করা হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজ রাত জেগে ইবাদত করবেন, মধ্যরাত্রিতে সেহরি খেয়ে আগামীকাল নফল রোজাও পালন করবেন। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন শবে বরাত উপলক্ষে আলোচনা এবং মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। এসব মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে ভোরে মোনাজাত পরিচালনা করা হবে।
হাদীস শরীফে এটাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত্রি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর পক্ষকাল পরেই আসবে রহমত বরকত নাজাতের মাহে রমজান। শবে বরাতকে বলা হয় রমজানের মুয়াজ্জিন। পবিত্র শবে বরাত সৌভাগ্যের রজনী হিসেবেও পরিচিত। মুসলমানদের কাছে ১৪ শাবান দিবাগত রাত অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত। মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতির জন্য তাঁর অসীম রহমতের দরজা খুলে দেন এ রাতে।
নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে,এই রাতেই পরবর্তী বছরের মৃত্যুবরণকারী মানুষ এবং পরবর্তী বছরের জন্মগ্রহণকারী শিশুদের তালিকা করা হয়।রাতভর নামাজ,কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আসকার,দোয়া মাহফিল,তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি ইবাদতে মগ্ন থাকাই এ রাতের প্রধান শিক্ষা,যে শিক্ষা জীবনব্যাপী অব্যাহত রাখার তাগিদ দেয়া হয় এ রাতে।
এই রাতের ইবাদত-বন্দেগীর গুরুত্ব অপরিসীম। ফার্সি শব্দগুচ্ছ শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। তবে আরবিতে একে বলা হয় লাইলাতুল বারাআত বা মুক্তির রাত। এ রাতে মানবসমাজ তথা বিশ্বের সব সৃষ্টির ভাগ্য নির্ধারণ করেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি মানুষের জীবন-মৃত্যুর দিনক্ষণ নির্ধারণ এবং রুজি-রোজগার বণ্টন করেন। নাজিল করেন বান্দার প্রতি অশেষ রহমত। বান্দাদের আকুতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণেরও রাত এটি। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং বিপদগ্রস্তদের দেখান উত্তরণের পথ। এ কারণেই মুসলমানদের কাছে শবে বরাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা)হতে বর্ণিত, রাসূল (দ)বলেছেন,শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে,তখন তোমরা এই রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছো কি কোনো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন (ইবনে মাজাহ)।তাই এই রাত আগমনের পূর্বেই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন থাকলে তা ঠিক করা ও কারও হক থাকলে তা আদায় করা বাঞ্ছনীয়।
শবেবরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকবে। এ রাতের তাৎপর্য তুলে ধরে রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। সংবাদপত্র প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে পবিত্র শবে বরাতের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সবার প্রতি মানব কল্যাণে ও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার আহবান জানান।
এ রাতের তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে নবী আকরাম সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু হাদীস রেওয়ায়েত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বিশুদ্ধ যে হাদীসটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে, “হযরত আবু মুসা (রা.) নবী করিম সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তা‘য়ালা শা‘বান মাসের মধ্য রাতে এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিরেকে সবাইকে ক্ষমা করে দেন’ (মুসনাদ)। ছহি হাদীস গ্রন্থ ইবনে মাজার অন্য একটি রেওয়ায়েতে এ রাত্রে আল্লাহ পাক হত্যাকারী ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল কুরআনে শিরককে জুলমে আজীম বা জঘন্য অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ শিরক আজ আমাদের সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে পড়েছে। তেমনিভাবে প্রতিনিয়ত হত্যা-হিংসা-বিদ্বেষ-জিঘাংসা আমাদের জীবনযাত্রাকে কলুষিত করে তুলছে। এ পাপগুলো আল্লাহর কাছে এত মারাত্মক ও অমার্জনীয় যে তিনি এমন পূণ্যময় রাতেও এ পাপের বোঝা বহনকারীকে ক্ষমা করবেন না। তাই আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত পেতে এসব পাপ থেকে তাওবা করে আমাদেরকে খালিছ নিয়তে ঈমানের পথে ফিরে আসতে হবে।
আলোচ্য হাদিসে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে মধ্য শা‘বানের রাতে ক্ষমা পাওয়ার জন্য শর্ত হলো অন্তরাত্মাকে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত করা। তাই কেউ যদি এ রাতের পুরোটাই নফল ইবাদত করে কিন্তু তার অন্তরকে এ দু‘ পাপ থেকে মুক্ত না করে তাহলে সে ক্ষমার অন্তর্ভূক্ত হবে না। আবার কেউ যদি এ রাতে কোন নফল ইবাদত নাও করে কিন্তু তার অন্তরকে শিরক ও হিংসা বিদ্বেষ থেকে মুক্ত রাখে তাহলে হাদিস অনুযায়ী তার ক্ষমা প্রাপ্তির প্রত্যাশা রয়েছে। অবশ্য সে নফল ইবাদতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে।
শা‘বান মাস রমজান মাসের পূর্ববতী ও সবচেয়ে নিকটতম মাস হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব ও ফজিলত সমৃদ্ধ। রাসুলে আকরাম সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসে প্রায়ই রোজা রাখতেন। হযরত আবু হরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজব ও শা‘বান মাস এলে দু‘আ করতেন এভাবে ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শা‘বানা ওয়া বাল্লিগ্না রামাদানা’ অর্থ্যাৎ হে প্রভূ! রজব ও শা‘বান মাসে আমাদের জন্য বরকত নাজিল করুন আর আমাদেরকে রমজানুল মুবারক পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।
অন্যান্য মাসের তুলনায় শা‘বান মাসের রোজা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে সবচে‘ বেশী প্রিয় ছিল। নবী করীম সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা‘বান মাস এলে বলতেন,“রমজানে সুষ্ঠুভাবে রোজা রাখার মানসে তোমরা শা‘বান মাসে রোজায় অভ্যস্ত হয়ে শরীরকে পাক-সাফ করে নাও। যে ব্যক্তি এ মাসে তিনটি রোজা রাখবে তার গুনাহ মাফ করা হবে’ (আবু দাউদ শরীফ)। এক্ষেত্রে আইয়ামে বীজের রোজা তথা চাঁদের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখের ৩টি রোজার রাখার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাসুলুল্লাহর প্রিয় সাহাবী হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) সে যুগের মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে বলেন, “তখন শা‘বান মাসের আগমন ঘটলে মুসলমানরা বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াতে মনযোগ দিতো এবং বিত্তশালীরা ফকীর-মিসকীনদের কাছে তাদের মালামালের যাকাত-ছদকা বিতরণ করতে থাকতো যাতে অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলো একটু স্বস্তি ও শক্তি সঞ্চয় করে রমজানের রোজাগুলো ভালভাবে অতিবাহিত করতে পারে।”
আজকাল শবে বরাতকে কেন্দ্র করে ইসলাম জায়েয না জায়েয নানা আয়োজন দেখা যায়, তা থেকে আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে। অনেকে এ রাতে ভোজন বিলাস, খেল-তামাশা,আতশবাজি, হৈ-হুড় ও দিক-বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। হাল জামানায় দেখা যায়, কেউ কেউ এ রাতে বিধর্মীদের দেখাদেখি ঘরের দরজায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে থাকে, গান-বাজনায় উৎসবে মেতে উঠে। ইসলামে এসব কর্মকা- কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তাওবা-ইসতিগফার ও দু‘আ-দরুদে মশগুল থাকা। তাছাড়া অন্যান্য রাতের ধারাবাহিকতায় তাসবীহ,তিলাওয়াতে কুরআন, সালাতুত তাহাজ্জুদ ও দান-খয়রাত করে মুমিন এ রাতে আল্লাহ পাকের রেজামন্দি হাসিল করতে পারে। মনে রাখতে হবে,কুরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞানার্জন করে তাকওয়া ও ইখলাস গুণে গুণান্বিত হতে না পারলে আমাদের জন্য কোন রাতই ক্ষমা ও বরকত বয়ে আনবে না। তাই শিরকমুক্ত ঈমান ও রিয়া বা লৌকিকতা বর্জিত আমলী জিন্দেগী গড়তে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সে তৌফিক দান করুন। আমিন!