প্রকাশিত: শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০২২ইং।। ৯ই বৈশাখ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।। ২০ রমজান,১৪৪৩ হিজরি ।।
বিক্রমপুর খবর : অফিস ডেস্ক :
“শহীদ সরদার মোঃ ইউনূছ”
যিনি এস এম ইউনূছ নামেই বন্ধুদের কাছে সমধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২২শে এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে একদল হায়েনারা খুন করে তাকে।
পরিচিতিঃ মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পয়শা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন সরদার মোঃ ইউনূছ। তার বাবার নাম রফিউদ্দিন সরদার।
তিনি ১৯৭০ সালে ব্রাহ্মণগাঁও হাই স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করেন। সে বছর তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় তিনি সেরা ছাত্র নির্বাচিত হন। তিনি শুধু সেরা ছাত্রই ছিলেন না সৎ চরিত্র, পরোপকারি সুন্দর ব্যবহার আর মিষ্টি কন্ঠের জন্য সকলের প্রিয় পাত্র ছিলেন।
বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আই এস সিতে ভর্তি হন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। তখন রাজনৈতিক ডামাডোলে উত্তাল শিক্ষাঙ্গন। স্বাধীনতার পিপাসায় বাঙালীরা তৃঞ্চার্ত। জগন্নাথের তৎকালীন উল্লেখযোগ্য ছাত্রনেতা রাজিউদ্দিন রাজু (সাবেক মন্ত্রী), কাজী ফিরোজ রশিদ (বর্তমানে এমপি), ইকবাল হোসেন (সদ্য প্রয়াত সাবেক এমপি), বৌলতলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবউল্লাহ মৃধা, গাউদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জি এম কবির, লৌহজং মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কমান্ডার খলিলুর রহমানসহ প্রমূখ নেতাদের প্রিয় বন্ধু ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তৎকালীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে মাতৃভূমিকে হায়েনার হাত থেকে মুক্ত করতে বন্ধুদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। রক্তপিপাসুদের পরাজিত করে স্বাধীনতার পর আবার কলেজে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে আই এস সি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে কৃতকার্য হন।
একই সাথে তৎকালীন ছাত্র সংসদের এজিএস নির্বাচিত হন। গঠনমূলক শব্দচয়ন, অমিয় যুক্তি আর মিষ্টিকন্ঠের বক্তৃতার সুবাদে খুব সহজেই নেতাদের নজর কারতে সক্ষম হন।
রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও লেখাপড়ায় কখনো ছেদ পড়তে দেয়নি সে। একই সাথে চলে বি এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি।
ইউনূছ বি এস সি পরীক্ষা শেষ করে ছুটি কাটাতে আসে গ্রামের বাড়ি পয়শায়। মায়ের আদর আর বাবার ভালবাসায় কেটে যায় বেশ কয়েকটি দিন। বন্ধুবান্ধবদের কোলাহলে স্মৃতিময় হয়ে উঠে দিনগুলো। মা বলে, যা তোর নানীকে দেখে আয়! লৌহজং এর ঝাউটিয়ায় ছিল নানার বাড়ি।
বৈশাখ মাসের শেষের দিকে আজকের এই দিনে (২২ শে এপ্রিল) পাট আর ধইঞ্চায় পরিপূর্ণ জমিগুলো। দখিনা বাতাস যেন ঢেউ খেলে যায়। জমির পাশ দিয়ে হেটে গেলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। পড়ন্ত বিকালে মায়ের কথামত নানীর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে ঝাউটিয়া রওনা হয় ইউনূছ। কুড়িগাঁও মঙ্গল শিকদারের বাড়ির দক্ষিণ দিকের খাল পাড় হওয়ার পরেই পাটক্ষেতে লুকিয়ে থাকা একদল সন্ত্রাসী খুব সামনে থেকে গুলি করে ইউনূছের পেটে। গুলির আঘাতে ভূড়ি বের হয়ে যায়। সেই পেট ধরেই বাঁচার জন্য দৌঁড় দেয় ইউনূছ।
আশেপাশে জমিতে অনেক লোক কৃষি কাজ করছিল। সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।
সেই পেট ধরেই প্রায় আধা কিলোমিটার দৌঁড়ানোর পরে কলিকাতা ভোগদিয়া নেকবর আলী শেখের বাড়ির উঠানে গিয়ে পড়ে যায়। বাড়ির লোকজন বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসলে ও খুনীরা তাদের চোখের সামনেই তার কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে আবারো গুলি করে নির্মমভাবে তাকে খুন করে। শেষ হয়ে যায় সব স্বপ্ন।
তার বাড়ির লোকজন খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে লাশ নিয়ে আসে বাড়িতে। এমন তরতাজা ছেলেটির নির্মম মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছিল না। মা বাবা, আত্মীয় স্বজনেরা যখন উচ্চঃস্বরে আহাজারি করছিল -তখন খুনিরা এসে শাসিয়ে যায়, “কেউ যেন চিৎকার না করে। কান্নাকাটি করলে আরো লাশ পড়বে।”
যে ছেলেটি স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করল -আর স্বাধীন দেশে সেই ছেলেটিকে পশুর মত খুন করা হলো। লাশ জড়িয়ে ধরে তার বাবা কাঁদতে কাঁদতে পারবে না- একবার ভেবে দেখুন তো কতোটা নরপিশাচ হলে এমনটা করা যায়! কিভাবে মানুষকে জিম্মি করেছিল তারা ?
স্বাধীনতার পরে একশ্রেণীর মানুষের কাছে অবৈধ অস্ত্র চলে আসে। অনেক নামধারী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র জমা না দিয়ে খুন, ডাকাতি আর ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পরে। তারা ব্যক্তিগত কলহের জিদ মিটানোর জন্য যুবক ছেলেদের ধরে এনে নির্মমভাবে আঘাত করত। মেরে ফেলতো। মহিলারা ঘরে থাকতে পারতো না তাদের ভয়ে।
অনেকেই নকশাল কিংবা সিরাজ সিকদার বাহিনী নামে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়।তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যায় বিক্রমপুরের মানুষ। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারেনা তাদের অত্যাচারে। প্রায় রাতেই বিভিন্ন বাড়িতে ডাকাতির খবর শোনা যায়। পাকবাহিনী যেভাবে বাঙালিদের মেধাশূন্য করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল-ওরা যেন তাদেরই পেতাত্মা রুপে আবির্ভূত হয়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ওরা বিভিন্ন দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে।
এমনো শোনা গেছে ডাকাতি করে ফিরে যাওয়ার সময় তারা “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে চলে যেত। মানুষ কিছু বলতে পারত না। কিন্তু মানুষ আসল ব্যাপারটি বুঝতো।যারা এমন জঘন্যতম কাজগুলো করেছে -তারা জীবদ্দশায় কোনদিন ও আওয়ামীলীগ করে নাই। আজো অনেকে জীবিত আছে।
এই নরপিশাচেরা চিরচেনা মুখ। প্রতিদিন সকাল হলেই এদের চেহেরা দেখা যায়। এলাকার সবাই এদেরকে চিনে। পরিচিত মুখ। এরা দূরের গ্রামের লোক নয়। কুড়িগাঁও, পয়শা, ভোগদিয়া গ্রামের কিছু কুলাঙ্গার। এমন নৃশংসতা তাদের মাধ্যমেই
সংঘটিত হয়েছে।
ছেলেকে হারানোর পর রফিউদ্দিন সরদার ক্ষোভে, ঘৃনায় বিক্রমপুর থেকে চিরতরে চলে যান পঞ্চগড়ে। সেখানেই সারাটি জীবন ছেলের জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।
মা বাবা তার সন্তানকে লেখাপড়া শেখায় অনেক আশা নিয়ে। বড় হয়ে শুধু সংসারের হাল ধরার জন্য নয়, সমাজের পট পরিবর্তনের জন্য। ইউনূছের অধিকাংশ বন্ধুবান্ধব আজ প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ। সে ছিল রাজনীতির উজ্জল নক্ষত্র। একটি ছেলের কারনে একটি এলাকায় উন্নয়নে জোয়ার আসতে পারতো। অথচ নরপিশাচেরা এই অমূল্য রত্নটাকে হত্যা করেছে। বাবা মায়ের লালিত স্বপ্নকে নির্মমভাবে খুন করেছে। ধিক জানাই ঐ হায়েনার বাচ্চাদের!!
পয়শা গ্রামে যাদেরকে খুন করা হয়ঃ
============================
★ ইউনূছ সরদারকে হত্যা করেই ওরা ক্ষ্যান্ত হয়নি। আরো খুন করেছে-
★ছব্দর আলী সরদার
( অমানুষিক নির্যাতন করে খুন করে মাহতাব উদ্দিন সরদারের বাবাকে)
★বারেক মোল্লা
(চানু আর তার অবুঝ বোনকে এতিম করে খুন করে তার বাবাকে)
★ পয়শা হাই স্কুলের জনৈক শিক্ষককে খুন করা হয়। তার নামটি জানা নেই।
★অল্পের জন্য রক্ষা পায় আলীম মোল্লা।
সারাজীবন সে বীভৎস স্মৃতি নিয়ে তিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন।
★ কুড়িগাঁও গ্রামের আব্দুল মৃধা,
(সাবেক মেম্বার তালেব মৃধার বাবা)
★আঁটি গাঁওয়ের গোফরান ও তার চাচাত ভাই (নামটি জানা নেই)
★দিঘলীর মাহতাব উদ্দীন বেপারী ও তার ভাই শান্তু বেপারী
★বেজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রমজান খানকে একই ভাবে তারা খুন করে। মাঝেমাঝে কোন অনুষ্ঠানে নাসির খান তার বাবা খুন হওয়ার বর্ননা দিতেন। এমনি ভাবে অনেক মেধাবী মানুষকে ওরা খুন করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল।
দিনে দুপুরে তারা নিজের মনে করে পরের ধনসম্পত্তি লুট করে নিয়ে যেত। এই শান্তি প্রিয় এলাকাটা অশান্তির আগুনে তারা দাউদাউ করে পুড়িয়েছে। তাদের অত্যাচারের ভয়ে ঐ বাড়িসহ এলাকার অনেক যুবকেরা রাজশাহী,নওগাঁ,পঞ্চগড় সহ উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বসবাস করে। এই খুনিরা ২/৪ জন মারা গেলে ও আজো তারা অনেকেই বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। জানি না এ কারনে কখনো তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল কিনা!
অথচ, কেউ প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে হয়েছেন বাকরুদ্ধ,কেউ তার পিতাকে হারিয়ে সারাজীবন বাবা ডাকা থেকে হয়েছে বঞ্চিত, মানুষের দূয়ারে কাঙালের মত বড় হয়েছে। তাদের ওতো স্বপ্ন ছিল, ছিল বেঁচে থাকার অধিকার। যার বাবা নাই, যে বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারে নাই। তার মনের যন্ত্রনা কিভাবে মিটাবে? পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস কি আছে- যেটা পেলে বাবা ডাকার সাধ পূর্ণ হয়? যাদের স্বজনদের অন্যায়ভাবে এমন করে খুন করা হয়েছিল -তারা ব্যক্তিগত ভাবে এ খুনের বদলা কেউ নেয়নি। কিন্তু তাদের অন্তরে এই ঘাতকদের জন্য যে ঘৃনার জন্ম হয়েছে- তা কি কোনদিন মুছে যাবে? এই প্রজন্মের অনেকেই জানে না এই না বলা কথাগুলো।তাদের জন্যই এই লেখাটি।
সময় চলে যায়। কিন্তু ইতিহাস তার সাক্ষী রয়।
সরদার মোঃ ইউনুছের ৪৮ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সেই সাথে সকল নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখকঃ ঢালী মনিরুজ্জামান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
(বিজ্ঞাপন) https://www.facebook.com/3square1
নিউজটি শেয়ার করুন .. ..
‘‘আমাদের বিক্রমপুর-আমাদের খবর।
আমাদের সাথেই থাকুন-বিক্রমপুর আপনার সাথেই থাকবে!’’