আইসোলেশনে থাকা দিনগুলো

0
41
আইসোলেশনে থাকা দিনগুলো

প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২৬মে ২০২০ ইং ।। ১২ই জ্যৈস্ঠ  ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।।

বিক্রমপুর খবর : কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল : লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করার সুবাদে মার্চ মাসের ৮ তারিখের পর থেকেই রুটিন কাজের সাথে অতিরিক্ত কাজ হিসেবে কোভিড -১৯ কাজ শুরু করলাম।

প্রথমেই দায়িত্ব ছিল বিদেশ ফেরৎ যাত্রিদের হোম কোয়ারান্টাইন নিচ্শিত করা।পরবর্তীতে পরবর্তিতে করোনা পজেটিভ রোগী বেড়ে যাওয়াতে এখন শুধু বিদেশ ফেরত নয় জেলার বাহির থেকে কেউ আসলে তাদের ও হোম কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করতে হতো।

লৌহজং এর নাগের হাটে প্রথম করোনা রোগি সনাক্ত হওয়ায় ১৩ই এপ্রিল আমিনুল ইসলাম দুলাল এর বাড়ি যেয়ে তাকে এম্বুলেন্স এ উঠিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠালাম। সে সময় ইউএনও মোহাম্মদ কাবিরুল ইসলাম খান সহ থানার উদ্ধর্তন কর্মকর্তা গন উপস্থিত ছিলে। সেদিন আমি দেখলাম দুলাল মিয়ার সাহস ও দৃঢ় মনোবল, যেটা করোনা রোগির আরোগ্য লাভের মূল চাবিকাঠি। এভাবে কাজ করে যাচ্ছি মে ৫ তারিখে লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ জন করোনা পজিটিভ সনাক্ত হলো।তাই আমি নিজেই মনের তাগিদে স্ব-উদ্দ্যোগে সোয়াব পরীক্ষা করালাম।

১০মে সাড়ে তিনটায় আমার মোবাইল অপশনে দেখতে পেলান আমি করোনা পজেটিভ বিন্দুমাত্র বিচলিত হলাম না। সাথে স্ত্রীকে ফোনে বললাম ২১ দিনের জন্য আমার জন্য আলাদা কক্ষ প্রস্তুত করার জন্য।স্ত্রী বুঝতে পাড়ল।বাড়ি এসে সব কিছু রেডি।প্রয়োজনিয় প্রস্ততি কাপড় চোপড় রেডি করে হোম আইসোলেশনে এ চলে গেলাম।

ফেস বুকে স্টেটাস দিয়ে আমি যে করোনা আক্রান্ত তা জানালাম এবং সবার দোয়া চাইলাম। এরই মধ্যে ডাঃ হুমায়ূন কবির এবং আমার দার্শনিক গুরু ডাঃ আবু ইউসুফ ফকির করোনা কালিন চিকিৎসা দিলেন। এজিন ৫০০ একটা করে দুই বেলা সাত দিন।জিন্ক বি ২ বার।সিভিট দিনে ৩বার।এভাবেই চিকিৎসা আরম্ভ হলো।

সেই সাথে দিনে ৪ বার গরম পানিতে লং,এলাচি,দাড়চিনি,গোল মরিচ, রসুন দিতে ভাপ নিতাম।আদা চা গরম পানিতে লেবু দিয়ে গড়গড়া করতাম। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত কোন ঔষধ সেবন না করাই যৌক্তিক। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে হাতুড়ে চিকিৎসকের পরামর্শ বা ঝাঁড়ফুক হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।

১১ তারিখে আমার পরিবারের বাবা মা ভাই বোন স্ত্রী মেয়ে ও গ্রামের সচেতন কয়েকজন মানুষ সহ ১৫ জনের সোয়াব বাড়িতেই পরী করালাম পরের দিন সকলেরই নেগেটিভ রেজাল্ট আসলো। এদিকে আমার একাকি বন্ধী জীবন চলতে থাকল।আসলেই বন্ধি জীবন যে কত কষ্টের তা যারা ভুক্ত ভোগি তাড়াই জানেন।

হোম আইলোশনেই আমি কারাগারের রোজ নামচা এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই দুটো পড়লাম।অনভব করলাম বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর কতই না কষ্টের করেছেন। কেলেন্ডার এর পাতায় এক একটি দিন যাচ্ছে আর কলম দিয়ে কাটছি।কারাগারে বই পড়ছি।কোরান পরছি।দিনে তিন বার ব্যায়াম করছি। গান শুনছি। মনে ফুর্তি ও সাহস,মনবল তুঙ্গে রাখার চেষ্টা করছি।শেখ হাসিনা আমাদের সম্মানিত প্রধান মন্ত্রী তার কথা টি আমার মনে অনুপ্রেরনা যোগাতো।তিনি বলেছিলেন সাহস আর দৃঢ় মনোবল করোনা রোগ ৯০ ভাগ এমনিতেই ছেড়ে যায় । স্ত্রী গরম দুধে হলুদ আর মধু দিয়ে খাওয়াতো শরীরে বাড়তি শক্তি পাওয়া যেত।এর মধ্যে আমার জীবনে বড় দুঃসংবাদটি শুনতে হলো ।যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

আমার প্রিয় মানুষটি আমার বাবা ১০১ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু বরন করেন। আজ আমি করোনা রোগী ।আমার বাবার কাছে যেতে পারছি না।

মনটাকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।একেবারেই ভেঙে পড়লাম।এদিকে একটি কুচক্রী মহল ইউ এন স্যারের নিকট অভিযোগ করছে আমার বাবা নাকি করোনা রোগি।

তারা আমাকে পিপিই পড়ে নির্দিস্ট দুরত্ব বজায় রেখে জানাজায় অংশ গ্রহনের পরামর্শ দিলেন ।আমি সেভাবেই প্রস্ততি নিচ্চি। হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাকে ফোন দিলেন আমি জানাজায় শরিক হলে অনেক লোক থাকবে না।তাই কি করবেন সিদ্বান্ত আপনার।কি করব ভেবে পাচ্ছি না। মনটাকে পাথর করে বুকের কষ্টটাকে ভেতরে লুকিয়ে রেখে জানাজায় যাওয়া বাদ দিলাম পাথর হয়ে গেলাম।কোন কথাই বলতে পারছি না।গুমরে গুমরে শুধুই কাদছি। মানষিক রড় ধরনরর আঘাত পেলাম।এদিকে কিছু লোক গুজব ছড়াল কাজী স্যার করোনা রোগি ছিল।যাতে জানাজায় লোক না আসে।আমার বাবার নাম কাজী আবুল হাশেম।উনি শিক্ষক ছিলেন। তাই এলাকার সবাই সংক্ষেপে কাজী স্যারই বলতেন।

এভাবে নানামুখী ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে তারপরেও অনেক লোক এসেছেন বাবার জানাজায়। সামাজিকদুরত্ব বজায় রেখে জানাজায় অংশ গ্রহন করেন তারা। আর যেই ভদ্রলোক আমকে জানাজায় আসতে নিষেধ করলেন পরে জানলাম তিনি জানাজায় আসেন নাই। তিনিতো আসলেনই না, আর আমাকেও আমার বাবার জানাজায় যেতে দিলেন না।যাক মনটা খুবই খারাপ । মানষিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে গেলাম।পরে স্ত্রী এসে অনেক বুঝাল।তোমার সন্তান দের জন্য হলেও তোমাকে বাচতে হবে।তোমাকে ধৈর্য্য ধারন করতে হবে। পরে রাতে ঘুমের টেবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।সকালে মেয়েদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো।মেয়ে গুলো খবর নেয় বাবা ঔষধ খেয়েছ? বাবা ব্যায়াম করেছে? এভাবে আমার কাজগুলো নিয়মিত করতে ওরা সহায়তা করছে।

সকলে বাবার করোনা পরীক্ষার রিপোর্টটা ফেসবুকে স্ট্যেটাস দিলাম।কুলঙার দের দেখালাম আমার বাবা পজেটিভ রোগী ছিলেন না। আমার ভায়রা এস এম মিজানুর রহমানের হোম আইসোলেশনে এর ১৪ দিন তাই ওর ফার্স্ট এলো এর সোয়াব নেওয়া হবে।

আমার হয়েছে ৯ দিন।যেহেতু গাওদিয়াতে সোয়াব নিতে আসছে আমার সোয়াব এ দিয়ে দিলাম ১৭মে তারিখে, ১৯ মে তারিখে আমার ভায়রারা সাথে আমার রিপোর্ট ও নেগেটিভ। কি আনন্দ, তা বলে বোঝানো যাবে না। ৮ দিনের মাথায় নেগেটিভ।

এটা সম্ভব হয়েছে আমার৷ নিয়মানুবর্তিতা মনে মনোবল আর স্বপ্নের সাথে পথচলা। আল্লাহ পাকের রহমত২০ মে তারিখে ২য় ফলোআপ এর সোয়াব দিলাম ২২তারিখে সৃস্টিকর্তার অশেষ রহমতে সর্বশেষ ফলোআপ ও নেগেটিভ। আমি এখন মুক্ত করোনা থেকে মুক্ত।

এ পৃথিবী থেকে করোন মুক্ত হতে আরো সময় লাগবে।বৈশ্বিক পরিস্হির কারনে টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু এভাবেতো চলতে পারে না।আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেদেরই নিশ্চিত করে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।আগামীর সুন্দর পৃথিবী কায়েম করতে হলে নিজের নিজেরই করতে হবে, তবেই মিলবে মুক্তি।

গত ২৩মে ২০২০ইং তারিখে লৌহজং উপজেলার সম্মানিত এ সি ল্যান্ড অফিসার মহোদয় আমাদের বাড়ি এসে দুই ভায়রাকে করোনা মুক্ত ঘোষণা করলেন এবং লক ডাউন প্রত্যাহার করে নিলেন।

পরিশেষে কবির ভাষায় বলবো।
” মেঘ দেখে কেউ করিছনে ভয়—
আড়ালে তার সূর্য হাসে।”-

সত্যি আমি আত্মপ্রত্যয় নিয়েই সাহসে ভর করেই আইসোলেশনের দিনগুলো পার করেছি।

লেখকঃ স্বাস্থ্য পরিদর্শক, লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।               নিউজটি শেয়ার করুন..

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার কমেন্টস লিখুন
দয়া করে আপনার নাম লিখুন