প্রকাশিত :রবিবার, ১২ এপ্রিল ২০২০ ইং ।। ২৯ চৈত্র ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।
বিক্রমপুর খবর :অনলাইন ডেস্ক :কিশোর কুমার দাস। এক স্বপ্নের নাম। এক ভালোবাসার নাম। যার শৈশব কেটেছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে। এখনো যুদ্ধ করছেন, তবে ভিন্ন এক যুদ্ধ। অসহায়দের মুখে হাসি ফুটানোর যুদ্ধ। ক্ষুধার্ত পেটে আহার দেয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তার সঙ্গে শরীক হয়েছেন আরও অনেকে।
বিদ্যানন্দ নামে গড়ে তুলেছেন সংগঠন। যে সংগঠন অসহায়দের খুঁজে বেড়ায়। তাদের কাছে টেনে নেয়। ভালোবাসায় মুড়িয়ে দেয় জীবন। এই উদ্যোগের পেছনেও রয়েছে কিশোরের অতীত। সেই অতীতই তাকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। বছর বিশেক আগের কথা। চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাটের এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠান শষে খাবার বিতরণ হচ্ছিল। ১৪ বছরের কিশোর তখন অন্যদের মতো লাইনে দাঁড়ায় এক প্লেট খাবারের আশায়। কিন্তু অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে খাবার আর পায়নি। ফিরে আসতে হয়েছিল খালি হাতে। আরেকটি ঘটনা- দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কলাপাতার ওপর সামান্য খাবার পেয়েছিলেন। তা নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটছিলেন বাড়িতে। মাকে নিয়ে একসঙ্গে খাবেন। সিনেমার গল্পকেও হার মানায় কিশোরের কাহিনী। খাবার নিয়ে যাওয়ার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে সব খাবার নষ্ট হয়ে যায়। সেই দিনের যন্ত্রনা আজও ভুলেনি কিশোর। আজ তার ক্ষুধার কষ্ট নেই। কিন্তু সেই অতীতকে স্মরণ করেই তিনি দাঁড়িয়েছেন দেশের শত শত ক্ষুধার্ত সুবিধাবঞ্চিতের পাশে। গড়েছেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। ২০১৩ সালের ২২ শে ডিসেম্বর শুরু করেছিলেন এই স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠার বছরের আগস্টে বড় বোন শিপ্রা দাশের সঙ্গে আলাপ করেই সিদ্ধান্ত নেন কিছু একটা করবেন সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য। ওই বছরই নারায়ণগঞ্জের বন্দরথানার সাব্দি গ্রামের পাঁচজন ছাত্র নিয়ে স্কুল শুরু করেন শিপ্রা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কিশোর এখন কাজের সুবাধে থাকেন আমেরিকায়। তবে তার গড়া এই সংগঠনটি প্রতিদিন দুই বেলা ‘এক টাকায় আহার’ বিতরণ করে দেশের প্রায় ১৮০০ পথশিশুর মধ্যে। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন দুপুরে ও রাতে শিশুরা সংগ্রহ করে এক টাকায় আহার। শুধু তাই নয়, নানান কার্যক্রম নিয়ে চলছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
এমন উদ্যোগের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে কিশোর কুমার দাস বলেন, আমি কিছু শারীরিক জটিলতা নিয়ে জন্ম নিয়েছিলাম। আমি কিছু মনে রাখতে পারতাম না। আরও নানা কারণে আমার শৈশবটা আসলে আনন্দময় ছিল না। কিন্তু, আমার অন্য ভাইবোনরা ছিল খুব মেধাবী, জীবনের ওই সময়টা ছিল খুব হতাশার। বাবা ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। উনি অবসরে যাওয়ার পরে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় টাকার অভাবে। তখন আমি কেবল এসএসসি পাস করেছি। যদিও ভাইবোনদের লেখাপড়া চলছিল। তখন কতজনকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছি, কিন্তু পড়ার জন্য আমি অর্থের সংস্থান পাইনি। শেষ পর্যন্ত দুই বছর পর একজন শিক্ষকের সহযোগিতায় আমি লেখাপড়ার করার সুযোগ পাই । এরপর কম্পিউটার সায়েন্স-এ ভালো একটা ফল নিয়ে পাশ করলাম চুয়েট থেকে। ২০০৬ সালে বিডিকমে চাকরি পান তিনি। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি তার। দেশি বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠানে ভালো পদে কাজ শুরু করেন তিনি।
যা করছে বিদ্যানন্দ: কয়েকমাস আগে স্বামী মারা যায় হাফেজা বিবির। কিন্তু শরীরে বেড়ে উঠছে আগত বাচ্চা। পরিবারে দুই বছরের এক মেয়ে শুধু, সেও অসুস্থ। এর আগেও একটা মেয়ে হয়ে মারা গেছে। বাসায় বৃদ্ধ শাশুড়ি। শরীরের এই অবস্থা, কাজ না করলেও না খেয়ে মরতে হবে সবাইকে। ১৫’শ টাকায় অন্যের বাড়িতে কাজ করেন হাফেজা বিবি। বিদ্যানন্দে এক গ্লাস দুধ প্রজেক্টে নিয়মিত আসেন তিনি। শেয়ার করেন তার কথাগুলো, কেউ কাজে রাখতে চাইছেনা এখন। এমন হাফেজা বিবিদের নিয়ে বিদ্যানন্দ-এর বাসন্তী প্রকল্প। সবাই যে সময়টায় চাকরিতে হিমশিম খেতে থাকে, ব্যবসার ক্ষতির কথা চিন্তা করে যাদের ফিরিয়ে দেয় গার্মেন্টসগুলো ,তারাই বাসন্তী! চ্যারিটি এই প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করেন তারা। বিদ্যানন্দের লড়াইয়ের গল্প অফুরান। রয়েছে বৃত্তি প্রদান, কখনো বা গোবিন্দগঞ্জের অসহায় সাঁওতালদের পাশে, রাঙামাটিতে পাহাড়ধস বিপর্যয়ে, ফ্রেমে বাঁধা শৈশব কর্মসূচিতে, হাওরাঞ্চলে ঈদ উৎসব আয়োজনে, আবার কখনো বা ছিন্নমূল শিশুদের জন্মদিন পালনে।
নিয়মিত ভিত্তিতে রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এক টাকায় আইনি সহায়তা, এক টাকায় চিকিৎসা কার্যক্রম। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যানন্দ প্রকাশনী কার্যক্রম। বিনা মূল্যে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য অভিবাসন সহায়িকা বিতরণ ও পথশিশুদের গোসল করানো। পাচঁটায় ন্যাপকিন, বইমেলায় পুরাতন জিনিসের বিনিময়ে বই, নির্বাচনী পোস্টারে লেখার খাতাসহ কত শত শত আয়োজন। বিনা মূল্যে পড়ানোর পাশাপাশি দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণ। যেখানেই মনে হয় ভালোবাসা দেয়া দরকার,সেখানেই বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা ছুটে যান আহার, শিক্ষা ও আনন্দ নিয়ে। বেশীরভাগ অস্বচ্ছল পরিবারের শিশুরা পায় না পড়াশোনার সুযোগ। আর সেই শিশুদের ভার নিতে কাজ করে যাচ্ছে বিদ্যানন্দ নামে শিক্ষা অনুকূল স্বেচ্ছাসেবক সংস্থাটি। অনাথ ও বঞ্চিত শিশুদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যানন্দ ৮ টি স্থানীয় শাখা সহ ৪০ জন কর্মকর্তা এবং শত শত স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাসে একদিন বড় পর্দায় বিভিন্ন শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র দেখানো হয় পিছিয়ে পড়া শিশুদের। শুধু সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য নয়, সর্বস্তরের পাঠকের জন্য রয়েছে পাঠাগার, যা বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। বিদ্যানন্দ গ্রহীতাদের ভেতর ‘ভিক্ষা’ ও বন্টনকারীদের মধ্যে ‘দান’ শব্দটি মুছে ফেলার চিন্তা থেকেই ‘এক টাকায় আহার’ কর্মসূচি।
এই কর্মসূচির আওতায় খাবার পেয়ে থাকে ১২ বছরের নিচের সুবিধাবঞ্চিত শিশু আর ৬০ বছরের হতদরিদ্র বৃদ্ধ। খাবারের যন্ত্রণা থেকে শিশুদের মুক্তি দেয়ার দৃঢ় এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। খাবার বিতরণের সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, প্রতীকী এই এক টাকা নিয়ে শিশুদের মধ্যে স্বাবলম্বি হওয়ার আগ্রহ সৃষ্টির প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের। শিশুরা যাতে ভিক্ষা বা দান নির্ভর না হয় সেটাই এই এক টাকা মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য। নিয়মিত খাবার মেন্যুতে থাকে ভাত, সবজি আর ডাল। তবে কেউ অনুদান দিলে খাবারের মেন্যুতে মুরগির মাংস, মাছ, ডিম, খিচুড়ি আর পোলাও দেয়া হয়। কোনো কোনোদিন করা হয় মিষ্টান্নের ব্যবস্থাও। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে কক্সবাজার জেলার রামুতে আদিবাসী অনাথদের একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সমপ্রীতি অনাথালয়। এক স্বেচ্ছাসেবক পরিবারের দান করা ১৫০ শতক জমির ওপর এটি গড়ে উঠেছে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নয়, তাদের গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। নিজের রুটি নিজেকেই বানাতে হয়, নিজেদের সবজি চাষ করতে হয়, এমনকি চুলও কাটতে হয় একে অপরের।
এভাবেই এখানকার শিশুদের স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু তাই নয় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের পাশেও দাড়িয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেসময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন আট হাজার মানুষকে শুকনো খাবার ও তিন হাজার মানুষের মধ্যে রান্না করা খিচুড়ি বিতরণ করেছিল তারা। এক টাকা আহারের স্বেচ্ছাসেবক সুলতানা জান্নাত শিখা মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রতিদিন প্রায় ১৮’শ জনের খাবারের ব্যবস্থা করি। সবাইকে খাওয়ানোর চেষ্ঠা করি। তবে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে অর্থসংকটে পড়তে হয়। তখন নিজেদের অর্থ থেকে দিয়ে ম্যানেজ করি। এটা আমাদের পরিবারের মতো।
নতুন করে আলোচনায়: বিদ্যানন্দ নতুন করে আলোচনায় এসেছে নির্বাচনী পোস্টার দিয়ে শিশুদের খাতা বানানোর প্রজেক্ট দিয়ে। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও কর্মীরা সেসব পোস্টার সংগ্রহ করে বানিয়েছেন খাতা। তাতে শিশুদের জন্য কেবল যে লেখার ব্যবস্থা হয়েছে তাই নয়, পেস্টারের আবর্জনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে ঢাকা। গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোট শেষে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগের ঘোষণা এলে ফেইসবুকে তা আলোচনার জন্ম দেয়। তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিজয়ী প্রার্থীরাও। ফাউন্ডেশনের কর্মী হাবিবুর রহমান সম্রাট বলেন, বিদ্যানন্দের শিক্ষার্থীদের সারা বছরের সকল বই-খাতা সরবরাহ করি আমরাই। ফলে প্রচুর খাতা দরকার হয় আমাদের। এমনও শিক্ষার্থী আছে, যারা ক্যালেন্ডারের পেছনে লেখে, পেন্সিলে লেখা খাতা রাবার দিয়ে মুছে আবার ব্যবহার করে। এই খাতার চাহিদা মেটানোর উপায় দেখতে পাই আমরা নির্বাচনী পোস্টারে। এছাড়া লিফলেটগুলোর পেছনের সাদা পৃষ্ঠা ফাউন্ডেশনের ১ টাকায় চিকিৎসা প্রকল্পের চিকিৎসকের পরামর্শপত্র বা প্রেশক্রিপশন লেখার কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
অনুদানের উৎস ও স্বেচ্ছাসেবকদের কথা : এই সংগঠনের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সবাই স্বেচ্ছাসেবক পরিচয় দিতে স্বাছন্দবোধ করেন। চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন প্রকল্পের প্রধানরাও নিজেদের পরিচয় দেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কিশোরের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কর্মসূচিটি শুরু হলেও বর্তমানে অনুদান আসে বিদ্যানন্দের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে। কেউ নিজের জন্মদিন উদ্যাপন বাজেটের টাকা দেন। কেউ হয়তো ঈদ বোনাসের টাকা। কেউ টিউশনির জমানো টাকা নিয়ে অভুক্ত শিশুদের পাশে এসে দাঁড়ান। এভাবে ব্যাক্তিপর্যায়ে অনুদান চলে প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যানন্দ- এর চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস আসেন প্রতি বছর রমাজানে।
তিনি যোগ দেন রমাজানের ইফতারি ও সেহরী প্রকল্পে। সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবক সুলতানা জান্নাত শিখা বলেন , শিক্ষার্থী, চাকরীজীবি তেকে শুরু করে এখানে অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। কিভাবে অনুদান সংগ্রহন করেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন ,আমরা ব্যাক্তি পর্যায় থেকে সবার থেকেই অনুদান গ্রহণ করি। তবে বির্তকিত ব্যাক্তিদের কাছ থেকে নয়। যারা অনলাইনে আমাদেরকে অনুদান প্রদান করেন, তাদেরকে প্রতিমাসে একসঙ্গে সবাইকে রশিদ দিয়ে থাকি।